অটিজম এর লক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা- অটিজম প্রতিরোধে করনীয়

অটিজম এর লক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সমাজের অনেকেই হয়ত সেরকম ভাবে সচেতন না। তবে বাংলাদেশের এই সমাজব্যবস্থায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি শিশু জন্ম নেবার পর যখন তার সাভাবিক লক্ষণ গুলোর প্রকাশে ভিন্নতা আসে তখন সেই শিশুর পিতার মাতার মধ্যে তৈরি হয় অস্থিরতা। বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা।
ভাবনা হয়, তাদের বাচ্চাটা কি আর সাভাবিক হবে না? পারবেনা আর সবার সাথে মিশতে? পারবেনা সাভাবিক ভাবে কথা বলতে? তারা যখন থাকবেনা তখন কি হবে? কে দেখবে তাকে? এর সব চিন্তাই "অটিজম" বিষয়ে কিছু বিষয়ে জানার ঘাটতির জন্য। এই পোস্টে মূলত অটিজম এর লক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ভূমিকা

একজন অটিস্টিক শিশুর পিতা-মাতা কে যেমন জানতে হবে তার শিশুর জন্য কি কি করনীয়, তেমনই অন্যান্য সবাইকে যানতে হবে তারা একটি অটিস্টিক শিশুর সাথে কিভাবে মেলামেশা করবে, তার সাথে কিভাবে কথা বলবে। সকলের প্রচেষ্টাতেই একমাত্র সম্ভব অটিজম কে সহজ করতে। অটিস্টিক শিশুর বিকাশ সাহায্য করতে। 

তাই আসুন আমরা অটিজম থেকে দূরে সরে না গিয়ে ভালভাবে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি। 

অটিজম কি

শিশুদের মস্তিস্কের বিকাশজনিত যে সমস্যা তার অপর নাম হল অটিজম। ইহা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নামেও পরিচিত। সাধারনট একটি শিশুর জন্ম নেবার তিন বছরের মধ্যেই বোঝা যায় তার অটিজম আছে কি না। সাধারনত অটিজম হলে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, কল্পনাশক্তি, আচারন ইত্যাদিতে বেশ কিছু ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।

অটিজম কত প্রকার

অটিজম সাধারনত পাঁচ রকমের হয়ে থাকে-

এসপারজারস সিনড্রোম

এসপারজারস সিনড্রোম শব্দটি ২০১৩ সালের পূর্বে বেশ ব্যবহার করা হত। তবে পরে লেভেল ১ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজওর্ডার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই অটিজমের ক্ষেত্রে শিশুর গড় বুদ্ধিমতা থাকে কিন্তু তারপরও সামাজিক যোগাযোগে সমস্যার সম্মুখীন হয়।

রেট সিনড্রোম

এটা সাধারনত শৈশবকালেই দেখা যায়। মেয়েদের মধ্যে এই অটিজমটি বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে এটি খুবই বিরল। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অ্যান্ড্রিস রেট প্রথম এই সিনড্রোমটি চিহ্নিত করেন।

চাইল্ডহুড ডিজইন্টারোগেটিভ ডিজওর্ডার

ডিজইন্টেগ্রেটিভ সাইকোসিস নামেও ইহা পরিচিত। মস্তিস্কের নিউরোবায়োলজিকাল ডিজওর্ডার এর জন্য এটি হয়ে থাকে বলে ধারনা করা হয়। ছেলেদের মধ্যে এই সিনড্রোম বেশি দেখা দেয়।

ক্যানার সিনড্রোম

ক্যানার সিনড্রোম হল অটিজমের ধরন যা বেশিরভাগ লোকেরা অটিস্টিক স্পেকট্রামে শিশুদের চিত্রিত করার সময় চিন্তা করে। এই ধরনের অটিজমকে ক্লাসিক অটিস্টিক ডিসঅর্ডারও বলা হয়, এবং এর লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যদের সাথে যোগাযোগ বা বোঝার চ্যালেঞ্জ, কার্যত চোখের যোগাযোগ না করা এবং উদ্দীপনার (গন্ধ, আলো, শব্দ, স্বাদ বা স্পর্শ) প্রতি অতিসংবেদনশীলতা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজওর্ডার

অন্যান্য সিন্ড্রোমের থেকে এটি খুব একটা সমস্যাকর নয়। এরা সাধারনত একটু দেরিতে কথা বলা, দেরিতে হাটতে শিখা ইত্যাদি এদের প্রধান লক্ষণ। অন্যান্য বিকাশে সাধারনত তারা একটু পিছিয়ে থাকে।

অটিজমের লক্ষণগুলো কি কি

এসপারজারস সিনড্রোম

  • অন্য বাচ্চাদের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা হবে।
  • একই কাজ বার বার করার প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে।
  • ভাব বিনিময়ে সমস্যা হবে।

রেট সিনড্রোম

  • শৈশবেই হামাগুড়ি দিতে সমস্যা হয়, কিছুদিন পর হাটটেও সমস্যা হয়।
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
  • যোগাযোগ এ বাধাগ্রস্থতা দেখা দেয়।
  • কথাতে বাধা দেখা যায়।
  • হাতের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
  • সাধারনত ছয় থেকে ১০ মাসের মধ্যেই এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে।

চাইল্ডহুড ডিজইন্টারোগেটিভ ডিজওর্ডার

  • মোটর দক্ষতা হারানো।
  • মূত্রাশয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানও। 
  • সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা দ্রুত হ্রাস।
  • পুনরাবৃত্তিমূলক অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি - শারীরিক ভাষা, গতি, ইত্যাদি।
  • খেলার দক্ষতা হারানো।
  • মলত্যাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো।

ক্যানার সিনড্রোম

  • সামাজিক যোগাযোগে অসুবিধা
  • পুনরাবৃত্তিমূলক বা সীমাবদ্ধ আচরণ
  • সংবেদনশীল প্রক্রিয়াকরণ সমস্যা
  • রূপান্তর বা রুটিনে পরিবর্তনের সাথে অসুবিধা

পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজওর্ডার

  • ভাষা ব্যবহার এবং বোঝার সমস্যা।
  • মানুষ, বস্তু এবং এই সম্পর্কিত ঘটনাগুলির সাথে অসুবিধা।
  • খেলনা এবং অন্যান্য বস্তুর সাথে খেলার বিভিন্ন মোড।
  • রুটিন বা পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সাথে অসুবিধা।
  • পুনরাবৃত্তিমূলক শরীরের নড়াচড়া বা আচরণের ধরণ।

অটিজম শিশুর ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা

বর্তমানে অটিজমের কোন চিকিৎসা নেই। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসা দ্বারা সংশ্লিষ্ট অসুবিধা এবং ঘাটতি কমানো এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং কার্যকরী স্বাধীনতা লাভ করা যায়। কোনো একক চিকিৎসাই সর্বোত্তম নয় এবং ব্যবস্থাপনাকে শিশুর প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করতে হবে।

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণগুলি দেখলেই প্রথমেই ডাক্তারে শরণাপন্ন হতে হবে এবং একজন ডাক্তার নিয়মিত চেকআপে বিকাশগত বিলম্বিত লক্ষণগুলি দেখবেন। আপনার সন্তান যদি অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের কোনো লক্ষণ দেখায়, তাহলে আপনাকে সম্ভবত একজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে যিনি অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করেন, যেমন একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট, বা ডেভেলপমেন্টাল পেডিয়াট্রিশিয়ান, মূল্যায়নের জন্য।

কারণ অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার লক্ষণ এবং তীব্রতায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, একটি নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে। ব্যাধি নির্ধারণের জন্য নির্দিষ্ট কোন মেডিকেল পরীক্ষা নেই। পরিবর্তে, একজন বিশেষজ্ঞ নিম্নলিখিত কাজ গুল করবে-
  • আপনার সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করবে এবং জিজ্ঞাসা করবে কিভাবে আপনার সন্তানের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ দক্ষতা এবং আচরণ সময়ের সাথে সাথে বিকশিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে।
  • আপনার সন্তানের শ্রবণ, বক্তৃতা, ভাষা, বিকাশের স্তর এবং সামাজিক এবং আচরণগত সমস্যাগুলি পরীক্ষা নিবে।
  • আপনার সন্তানের কাছে কাঠামোগত সামাজিক এবং যোগাযোগের মিথস্ক্রিয়া উপস্থাপন করবে এবং কর্মক্ষমতার একটি স্কোর করবে।
  • আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রকাশিত ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার (DSM-5) এর মানদণ্ড ব্যবহার করা হবে।
  • রোগ নির্ণয়নের জন্য অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

অটিজম প্রতিরোধে করনীয়

সচেতনার মাধ্যমেই একমাত্রে এর প্রতিরোধ করা যায়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অনুসরন করা যেতে পারে-
  • অনেকক্ষত্রেই অটিজম জেনেটিক সমস্যার কারনে হয়ে থাকে। তাই পরিবারের কার অটিজম থাকলে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে গর্ভধারন করতে হবে।
  • গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, দুশ্চিন্তা করা যাবে না, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। 
  • গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস খুবই সাবধানে থাকতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোন ঔষধ সেবন বা অন্য কোন কাজ না করায় ভাল। 
  • বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 
  • গর্ভবতি মায়ের ধুমপান, মদ্যপান বা অন্য কোন নেশা না করা। আর এরকম নেশার অভ্যাস থাকলে তা অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। 
  • বাচ্চাকে জন্মের প্রথম দুইমাস অব্যশই বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং এর পর থেকে সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। 
  • বাচ্চা বড় হবার সাথে সাথে মাতা পিতার সাথে বাচ্চার সম্পর্কও বাড়াতে হবে। আশে পাশের মানুষের সাথেও মেলা মেশা বাড়াতে হবে। 

বিশ্ব অটিজম দিবস

২রা এপ্রিল বিশ্ব অটিজম দিবস। জাতিসংঘ এই দিনে তার সদস্য দেশগুলিকে অটিজম সম্পর্কে বিভিন্ন সচেতনা কার্যক্রম গ্রহণে উৎসাহ প্রদান করে আসছে। ২০০৭ সালে ১লা নভেম্বর জাতিসংঘে এই দিবস সম্পর্কে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল এবং ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি গ্রহন করা হয়।

শেষ কথা

অটিজম কখনই পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয় তবে সঠিক পরীক্ষাম চিকিৎসা, এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে ৯০-৯৫ ভাব শিশুর আচারন স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। অনেক অভিভাবক আশা ছেড়ে দেয় কিংবা হতাশ হয়ে যায়। কখনই ধৈর্য্য হারানও যাবে না। 

সবাই সাহায্য করলেও পিতা-মাতা ধৈর্য্যশীল না হলে কখনই সন্তানের ডেভেলপমেন্ট সম্ভব হবে না। এছাড়াও বাংলাদেশে বর্তমানে অটিজম নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। ভাল ভাল চিকিৎসক আপনার অটিস্টিক সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সবসময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

অটিজম সম্পর্কিত আমার এই পোষ্টটি আপনার উপকারে আসলে আপনি শেয়ারে করে আপনার পরিচিতদেরও অটিজম সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিন এবং এই সম্পর্কে সচেতনা বাড়াতে এগিয়ে আসুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url