সহজেই গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরির পদ্ধতি
গোবর সার একটি প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব সার যা সহজেই গরুর গোবর থেকে তৈরি করা যায়। এটি মাটির উর্বরতা বাড়াতে এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে কার্যকর। সঠিক পদ্ধতিতে গোবর সংগ্রহ, মিশ্রণ এবং পচন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে ঘরে বসেই জৈব সার তৈরি করা সম্ভব। এই পোষ্টে মূলত কিভাবে সহজেই গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরি করা যায় তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "সহজেই গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরির পদ্ধতি" সম্পর্কে বিস্তারিত।
১. ভূমিকা
গোবর সার প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব একটি জৈব সার, যা মূলত গরুর গোবর থেকে তৈরি করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে কৃষিক্ষেত্রে গোবর সার ব্যবহৃত হয়ে আসছে, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়াতে এবং ফসলের ফলন উন্নত করতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে।
আজকের দিনে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি দূষিত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে অনেক কৃষক এবং পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি পুনরায় জৈব সারের দিকে ঝুঁকছেন।
গরুর গোবর থেকে খুব সহজেই সার তৈরি করা যায় এবং এটি খরচেও সাশ্রয়ী। গোবরের সাথে খড়, শুকনো পাতা এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ মিশিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে পচানোর মাধ্যমে কার্যকর জৈব সার প্রস্তুত করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়া মাটির গুণগত মান উন্নত করে, মাটির pH মাত্রা স্থিতিশীল রাখে এবং পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
বর্তমনে অনেকেই বাণিজ্যিক ভাবে খামারে গরু পালন করছেন। আবার অনেকে তার নিজ বাসাবাড়িতেও গরু পালন করছেন। তারা যেমন গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরি করে নিজেদের আবাদি জমিতে বিনে খরচে ব্যবহার করতে পারেন তেমনি অন্যের কাছে এই গোবর সার বিক্রির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভাবেও লাভবান হতে পারেন।
২. জৈব সার কাকে বলে
উদ্ভিদ ও প্রানীর দেহাংস বা রেচন পদার্থ থেকে যে সার প্রস্তুত করা হয় তাই জৈব সার। যেমন- গরুর গোবর, সবুজ সার, খৈল, হাড়গুড়া, কাঠের ছাই ইত্যাদি। জৈব সার কার্বন সমৃদ্ধ সার।
৩. বিভিন্ন প্রকার জৈব সার
জৈব সারের অনেক রকম ধরন দেখা যায়। যেমন-
- পচা গোবার সার- মানুষের মল, গরুর গোবর, হাস-মুরগীর বিষ্ঠা ইত্যাদি।
- কম্পোষ্ট সার- ফসলের অংশবিশেষ, আগাছা, কচুরিরপনা, সবজি, ময়লা আবর্জনা ইত্যাদির পচনের ফলে তৈরি সার।
- সরিষার খৈল সার
- ধৈঞ্চা সবুজ সার
৪. জৈব সার এ কি কি উপাদান আছে
জৈব সারের পুষ্টিগুন অনেক বেশি হওয়ার কারনে উদ্ভিদের জন্য তা খুবই উপকারী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা কাউন্সিলের (BARC) মতে বিভিন্ন রকম জৈব সার এ নিম্নলিখিত উপাদানগুলি বিদ্যমান-
- গোবারের জৈব সার এ ৩৫% আর্দ্রতা, ১.২% নাইট্রোজেন, ১.০% ফসফরাস, ১.৬% পটাশিয়াম এবং ০.১৩% সালফার
- মুরগীর বিষ্ঠা সার এ ৫৫% আর্দ্রপ্তা, ১.৯% নাইট্রোজেন, ০.৫৬% ফসফরাস, ০.৭৫% পটাশিয়াম এবং ১.১ সালফার
- কম্পোষ্ট সার এ ৪০% আর্দ্রপ্তা, ০.৭৫% নাইট্রোজেন, ০.৬% ফসফরাস এবং ১.০% পটাশিয়াম
- সরিষার খৈল এ ১৫% আর্দ্রপ্তা, ৫% নাইট্রোজেন, ১.৮% ফসফরাস এবং ১.২% পটাশিয়াম
৫. গোবর সারের উপকারিতা
গোবর সার প্রাকৃতিক সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা কৃষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মাটি উন্নত করতে সহায়ক এবং ফসলের ফলন বাড়াতে কার্যকর। গোবর সারের উপকারিতা বিস্তারিতভাবে নিম্নে আলোচনা করা হল-
৫.১. মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি
গোবর সার মাটিতে জৈব পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা মাটির গুণগত মান উন্নত করে। এটি মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং এর মাধ্যমে ফসলের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে সহায়ক হয়।
৫.২. পরিবেশবান্ধব
গোবর সার একটি প্রাকৃতিক সার হওয়ায় এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। রাসায়নিক সার ব্যবহারে যে পরিবেশ দূষণ ঘটে, তা গোবর সার ব্যবহারে হয় না। এতে মাটির জৈবিক গুণাবলী অটুট থাকে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রেও কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।
৫.৩. ফসলের ফলন বৃদ্ধি
গোবর সার ব্যবহারে মাটির পুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ফসলের ফলন বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি ফসলের রুট সিস্টেম শক্তিশালী করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
৫.৪. মাটির pH মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
গোবর সার মাটির pH মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক। এটি মাটির অম্লত্ব কমায় এবং মাটি আলকেলিন হলে তা উন্নত করে। এর ফলে ফসলের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৫.৫. মাটির ক্ষয় রোধ
গোবর সার ব্যবহারে মাটির ক্ষয় রোধ হয় এবং মাটির স্ট্রাকচার মজবুত থাকে। এটি মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়ক, যা ফসলের সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।
৫.৬. কম খরচের সমাধান
গোবর সার কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী বিকল্প। রাসায়নিক সার ব্যবহারের তুলনায় গোবর সার সহজলভ্য এবং কম খরচে পাওয়া যায়। ফলে এটি কৃষকদের জন্য আর্থিকভাবে সুবিধাজনক।
৬. গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরির পদ্ধতি
গরুর গোবর পচিয়ে যে সার তৈরি করা হয় তাই গোবর সার। যেসব বাড়িতে বা খামারে গরু আছে সেখানে গোবরের উৎপাদন অনেক বেশি। কিন্তু উপযুক্ত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করায় দেখা যায় এর বেশির ভাব অংশই নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই এই গোবর গুলি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জড় করে রাখেন।
আবার অনেকেই গর্ত করে গোবর রাখলেও উপরে কোন আচ্ছাদন দেয় না। ফলে রোদ এবং বৃষ্টিতে এর গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তাই উপযুক্ত পদ্ধতিতে যদি প্রতিদিন এই গোবরগুলি সংরক্ষোণ করা যায় তবে ভাল মানের গোবরের জৈব সার তৈরি সম্ভব।
৬.১. গোবর সার তৈরির উপকরণ
গোবর সার তৈরি করতে প্রয়োজন কিছু মৌলিক উপাদান:
- গরু বা মহিষের গোবর
- খড়, পাতা বা অন্যান্য জৈব পদার্থ
- পানি
- টি.এস.পি
- প্রয়োজন হলে কিছু ছাই
৬.২. গোবর সার তৈরির পদ্ধতি
উন্নত পদ্ধতিতে গোবরের জৈব সার তৈরিতে যে পদ্ধতিগুলো অনুসরন করতে হবে তা হল-
- গোয়াল ঘরের কাছা কাছি ৫ (১.৫ মিটার) ফুট চওড়া, ১০ ফুট (৩ মিটার) লম্বা এবং ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি (১ মিটার) গভীরের একটি গর্ত তৈরি করতে হবে।
- গর্তের দেওয়ালগুলো ভাল ভাবে সমান রাখতে হবে।
- গর্তের নিচে পিটিয়ে সমান করতে হবে এবং সেখানে বালি, খড় বিছিয়ে দিতে হবে যেন সহজেই পানি শুষে নেয়।
- গর্তের চারপাশে মাটি দিয়ে উচু করে রাখতে হবে যেন বৃষ্টির সময় সহজে পানি প্রবেশ করতে না পারে।
- গর্তটির উপর উচু করে অবশ্যই চালা দিয়ে দিতে হবে। এতে করে রোদে শুকিয়ে যাবেনা এবং বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাবে না।
- গর্তটিকে দুইটি ভাগে ভাগ করতে হবে। যেন একটি গর্ত ভরাট হয়ে গেলে অপর গর্তে গোবর ফেলা যায়। টিন দিয়ে বা শক্ত কিছু দিয়ে এই ভাগ করা যায়।
- প্রতিদিনের গোবর গর্তের যেকোন একটি ভাগে ফেলতে হবে। মাঝে মাঝে এর সাথে মিহি মাটি ফেলতে হবে। এতে করে গোবরের গ্যাস উড়ে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে।
- গোবরের সাথে সমপরিমাণ খড়, পাতা বা অন্যান্য জৈব পদার্থ মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণটি জৈব পদার্থকে পচাতে এবং গোবর সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। চাইলে এতে সামান্য ছাইও যোগ করা যায়, যা পুষ্টিগুণ বাড়ায়।
- গোবরের স্তরের উপর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে মিশ্রণটি ভিজে থাকে এবং পচন দ্রুত হয়। এটি প্রায় ২-৩ ফুট উঁচু স্তর হতে পারে। স্তরের উচ্চতা বেশি হলে ভালো পচন হবে এবং গোবর সার তৈরির সময়ও কম লাগবে।
- গর্ত ভরাট হলে প্রায় দেড় মাস পর এই গোবর ওলোট পালোট করে দিতে হবে। এর সাথে পরিমাণমত টি.এস.পি মিশানো যেতে পারে।
- এই গোবর ২ মাস পর গোবর সার এ পরিনত হবে এবং ব্যবহার উপযোগী হবে।
৭. গোবর সার সংরক্ষণ
গোবর সার সংরক্ষণ করতে হলে শুষ্ক জায়গায় এটি রাখতে হবে। খোলা জায়গায় রাখা হলে বৃষ্টি বা আর্দ্রতার কারণে সারের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। শুকনো এবং ছায়াযুক্ত জায়গায় গোবর সার মজুদ করলে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
শেষ কথা
গরুর গোবর থেকে খুব সহজেই গোবর সার তৈরি করা সম্ভব এবং এটি কৃষিতে একটি দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সমাধান। সঠিক পদ্ধতিতে গোবর মিশ্রণ তৈরি করে এবং পর্যাপ্ত পচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে কার্যকরী জৈব সার উৎপাদন করা যায়।
এই প্রক্রিয়াটি শুধু মাটির উর্বরতা বাড়ায় না বরং ফসলের ফলনও বৃদ্ধি করে। রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গোবর সার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে গোবর সার তৈরি ও ব্যবহার করে আমরা কৃষি উন্নয়নে আরও কার্যকর অবদান রাখতে পারি।
"সহজেই গরুর গোবর থেকে গোবর সার তৈরির পদ্ধতি" পোস্ট সম্পর্কিত মন্তব্যের জন্য নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত বা পরামর্শ শেয়ার করুন। আপনার ফিডব্যাক আমাদের উন্নতির পথে সাহায্য করবে!
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
গোবর থেকে কিভাবে সার তৈরি করতে হয় আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি কিন্তু এত সুন্দর ভাবে বিস্তারিত ভাবে কোথায় এমন পোস্ট পাইনি। এই পোস্টের মাধ্যমে সহজেই জানতে পারলাম। আশা করি কচুরিপানা থেকে কিভাবে সার তৈরি করা যাবে এই বিষয়টি পোস্ট চাই।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! আমাদের পোস্টটি আপনাকে সাহায্য করেছে জেনে সত্যিই আনন্দিত। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে এমন সহজবোধ্য ভাষায় বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা, যা থেকে প্রত্যেকেই উপকৃত হতে পারেন। কচুরিপানা থেকে সার তৈরির পদ্ধতি নিয়েও অবশ্যই একটি পোস্ট করার পরিকল্পনা করছি। খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আসছি। আমাদের সাথে থাকুন, এবং নতুন বিষয়বস্তু জানতে আমাদের ব্লগটি ঘুরে দেখুন। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ!