ওমেগা-৩ (Omega-3) ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার কি কি এবং মানব দেহে এর গুরুত্ব
ওমেগা-৩ একটি এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দুই ধরনের ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়-১. এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড ও ২. নন-এসেসসিয়াল ফ্যাটি এসিড। এই এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড মানুষের শরীর তৈরি করতে পারেনা, খাবারের মাধ্যমেই আমরা এই এসিড পেয়ে থাকি। এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ফ্যাটি এসিডই হল ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, দৃষ্টি শক্তির উন্নতি, ব্রেনের কার্যকারিতা ও স্মৃতিশক্তির বৃদ্ধি, নারী পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্ডিও ভাস্কুলার স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কোন কোন খাবারে পাওয়া যায়, এর অভাবে আমাদের শরীরে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
এই পোষ্টে মূলত এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ারই চেষ্টা করা হয়েছে। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সম্পর্কে।
ভূমিকা
পুষ্টি বিজ্ঞানিদের মতে শরীরের কার্যক্রম চালানর জন্য ভিটামিন এর পাশাপাশি চর্বিরও প্রয়োজন রয়েছে। অতিরক্ত ক্যালরির ভয়ে অনেকেই এই চর্বিযুক্ত খাবার গুলো এড়িয়ে চলেন এবং ওমেগা-৩ কে নগণ্য মনে করেন। যে বিষয়টি একেবারেই সঠিক নয়।
এগুলি মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের কাঠামোর অংশ, এগুলো মানুষের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং হৃদপিন্ড, ফুসফুস, রক্তনালী এবং ইমিউন সিস্টেম যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কি
পলি আন স্যাটুরেটেড ফ্যাটি এসিডের (polyunsaturated fatty acid) অন্তর্ভুক্ত হল এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যার মধ্যে রয়েছে Eicosapentaenoic acid (EPA), Docosahexaenoic acid (DHA) ও ALPHA-LINOLENIC ACID (ALA). এগুলোর মধ্যে Eicosapentaenoic acid (EPA) এবং Docosahexaenoic acid (DHA) মাছের তেল থেকে পাওয়া যায়। অপরদিকে ALPHA-LINOLENIC ACID (ALA) উদ্ভিজ্জ তেল থেকে পাওয়া যায়।
যেহেতু আমাদের শরীর প্রাকৃতিক ভাবে এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড তৈরি করতে পারেনা, সেহেতু শরীরের প্রয়োজনে বিভিন্ন খাবার থেকেই আমাদের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করতে হবে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের উপকারিতা
মস্তিস্ক এবং হার্ট থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন কাজে ওমেগা-৩ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
নিচে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের বেশকিছু উপকারিতা আলোচনা করা হল-
হার্টের স্বাস্থ্য
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। এটি ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। রক্তে অত্যধিক ট্রাইগ্লিসারাইড (হাইপারট্রিগ্লিসারাইডেমিয়া) এথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং এর মাধ্যমে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। সুতরাং, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, ওমেগা-৩ HDL (ভাল) কোলেস্টেরল বাড়াতে এবং রক্তচাপ কমাতা সাহায্য করে।
অটোইম্মিউন রোগ
মাছ এবং মাছের তেলে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গুলি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস এবং ক্রোনের রোগের মতো বিভিন্ন অটোইমিউন রোগের লক্ষণগুলিতে সাহায্য করতে পারে।
বিষণ্ণতা
বেশ কিছু ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ দেখা গেছে যে, যারা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট থেকে ত্রাণ পাচ্ছেন না সেসব লোকগুলোর ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড গুলি খুব ভাল কাজ করে। বিভিন্ন গবেষণার একটি মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ওমেগা-৩ বিষণ্নতার কিছু উপসর্গ উপশম করতে সাহায্য করতে পারে।
শৈশবে মস্তিষ্কের বিকাশ
ক্রমবর্ধমান শিশুর জন্য গর্ভবতী হওয়ার সময় মা কে প্রচুর ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার খেতে হবে। এটি সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং চিন্তাভাবনা এবং যুক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের হাঁপানি
উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ যুক্ত খাদ্য শিশুর হাঁপানির উপসর্গ হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। গবেষকরা পরামর্শ দেন যে বাচ্চারা যখন ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার বেশি খায় এবং সয়াবিন এবং কর্ন তেলের মতো ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার কম খায় তখন তারা আরও সুরক্ষিত থাকে।
প্রতিদিন আমাদের শরীরে কি পরিমাণ ওমেগা-৩ এর প্রয়োজন
স্বাস্থ্যকর ডায়েটের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ প্রতিদিন প্রায় ১-১.৫ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খাওয়ার পরামর্শ দেয়। এটা সবচেয়ে ভালো যদি এটা ফুড সাপ্লিমেন্ট এর পরিবর্তে সরাসরি খাবার থেকে আসে।
কোন কোন খাবারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়
চর্বিযুক্ত মাছ
চর্বিযুক্ত মাছ এ আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ও ভিটামিন-ডি এর অফুরন্ত ভান্ডার। সপ্তাতে দুই তিন দিন এই চর্বিযুক্ত মাছ খেলে হার্ট ভাল থাকে এবং স্ট্রোক এর ঝুকি হ্রাস পায়। যেসব চর্বিযুক্ত মাছে ওমেগা-৩ পাওয়া যায় তা হল-
- অ্যাঙ্কোভিস (Anchovies)
- ব্লুফিশ (Bluefish)
- ফ্লাউন্ডার (Flounder)
- মিঠা পানির ট্রাউট (Freshwater Trout)
- হেরিং (Herring)
- স্যালমন মাছ (Salmon)
- সার্ডিনস (Sardines)
- স্টার্জন (Sturgeon)
- টুনা (Tuna)
তিসির বীজ
তিসির বীজ এ থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ভিটামিন-ডি ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং হাড়ের জয়েন্ট ও মস্তিস্ক ভাল রাখে। প্রতিদিন নাস্তায় এক চামচ তিসির বীজ খেলে ওমেগা-৩ এর ঘাটতি হবেনা।
সেদ্ধ ডিম
সেদ্ধ ডিম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ভিটামিন-ডি এর অসাধারন একটি উৎস। মানসিক চাপ কমাতে এনং চুল ও ত্বকের লাবন্যতা ধরে রাখতে প্রতিদিন সকালের নাস্তায় একটি সেদ্ধ ডিম খাওয়া অত্যন্ত জরুরী।
চিয়া সিড
চিয়া সিড এ থাকা শক্তিশালী এ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন ই, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ভিটামিন-ডি রক্তশূন্যতা দূর করে হাড়ের ক্ষয় রোধ করে, ইমিউনিটি সিস্টেম ভাল রাখে। প্রতিদিন সালাদের সাথে চিয়া সিড মিশিয়ে খাওয়া যায়।
কাঠ বাদাম
গুরুত্বপূর্ন এ্যামাইনো এসিড, ভিটামিন-ই এবং ওমেগা-৩ এর অন্যতম উৎস হল কাঠ বাদাম যা চোখ ভাল রাখে , দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করে এবং হার্টের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন।
আখরোট
এককাপ আখরোট থেকে সাধারণত ৩৪৬ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। ওমেগা-৩ এর চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন একমুঠ আখরোট সালাদ বা নাস্তার সাথে আমরা খেতে পারি।
সরিষার তেল
জলপাই তের থেকেও বেশি উপকারী বা স্বাস্থকর মানা হয় এই সরিষার তেলকে। প্রতিদিনের রান্নায় বা সালাদে এই তেলের ব্যবহার আপনার শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যোগানের পাশাপাশি কোলেস্টেরল শোষনে বাধা দেয়।
মন্তব্য
একটি শিশুর বেড়ে ঊঠার জন্য ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খুবই গুরুত্বপূর্ন। অবহেলার জন্যে অনেক শিশুরই ছোট থেকেই তার বুদ্ধির বিকাশে সমস্যার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। তাই গর্ভাবস্থা এই ওমেগা-৩ গ্রহণের বিষয়ে থেকেই সচেতন হতে হবে। আবার অতিরিক্ত ওমেগা-৩ সেবন বেশ কিছু পার্শপতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারেন। তাই সঠিক নিয়মে সঠিক মাত্রায় ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার সেবন অত্যন্ত জরুরী। ধন্যবাদ।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url