গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা, কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়

গর্ভবতী মা এবং শিশুর জন্য গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক কি? এসময় আমাদের কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়।
গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা,  কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়
এই পোষ্টে মূলত গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দেওয়ার এবং এই সময় করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচান করা হয়েছে। তাই চলুন যেনে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা কি এবং এই সময় আমাদের কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়।

ভূমিকা

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা গর্ভের শিশুর গঠন ও গড়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইসময়ই ভ্রূণের প্রধান অঙ্গগুলো এবং শারীরিক সিস্টেমের বৃদ্ধি এবং বিকাশ শুরু হয়। গর্ভবতী মায়ের শরীর ও মনেও আসে নানা পরিবর্তন। তাই এই সময় গর্ভবতী মা কে বেশ কিছু বিষয়ে খেয়াল রেখে চলতে হয়। এক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও অনেক সচেতন হতে হয়।

তাই গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থা সম্পর্কে সাধারন ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় করণীয় এবং বর্জনীয় দিকগুলো সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা থাকলে অনেক জটিল সমস্যা হতে মুক্তি পাওয়া যায়, আবার ভবিষ্যতের জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করা যায়। 

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক কি?

গর্ভাবস্থার তিনটি ত্রৈমাসিক বা পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি ত্রৈমাসিক প্রায় ১৩ সপ্তাহ বা তিন মাস দীর্ঘ। একটি পূর্ণ-মেয়াদী গর্ভাবস্থা ৪০ সপ্তাহ বা নয় থেকে দশ মাসের মধ্যে স্থায়ী হয়। আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সপ্তাহের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে আপনার সাথে কথা বলবেন। আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক, গর্ভাবস্থার ১৩ তম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

আপনার গর্ভাবস্থা আসলে আপনার শেষ মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়। একে গর্ভাবস্থার গর্ভকালীন বয়স বলা হয়। একজন ডাক্তার সাধারণত, আপনার শেষ মাসিকের প্রথম দিনের সাথে ৪০ সপ্তাহ যোগ করে সম্ভাব্য জন্ম তারিখ গণনা করে। সুতরাং এর মানে, আপনি যখন জানেন যে আপনি গর্ভবতী, ইতিমধ্যে আপনার গর্ভকালীন বয়স প্রায় চার সপ্তাহ হয়ে গেছে।

প্রথম দুই সপ্তাহ

গর্ভাবস্থার প্রথম দুই সপ্তাহ হল আপনার স্বাভাবিক "মাসিক চক্রের" অংশ — প্রথম সপ্তাহ হল আপনার পিরিয়ড এবং দ্বিতীয় সপ্তাহ হল ডিম্বস্ফোটন। একবার আপনি ডিম্বস্ফোটন করলে, আপনার ডিম আপনার ফ্যালোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে আপনার জরায়ুতে চলে যায়। যদি এটি শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়, তারা একত্রিত হয় এবং গর্ভধারণ ঘটে (নিষিক্তকরণ)।

তৃতীয় সপ্তাহ

গর্ভাবস্থার তৃতীয় সপ্তাহে, নিষিক্ত ডিম্বাণু আপনার জরায়ুতে চলে যায়। একবার এটি আপনার জরায়ুতে পৌঁছালে, এটি আপনার জরায়ু আস্তরণে ইমপ্লান্ট করে। এটি আপনার শরীরকে ট্রিগার করে যে আপনি গর্ভবতী এবং একটি ধারাবাহিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

প্রথম ত্রৈমাসিক অবস্থার সময়কাল

আপনি গর্ভবতী হওয়ার আগে প্রথম ত্রৈমাসিক শুরু হয়। এটি আপনার শেষ মাসিকের প্রথম দিনে শুরু হয় এবং গর্ভাবস্থার ১৩ তম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে।

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক কেন গুরুত্বপূর্ণ

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন, এই সময় ভ্রূণের প্রধান অঙ্গগুলো এবং শারীরিক সিস্টেমের বৃদ্ধি এবং বিকাশ হতে থাকে। টক্সিন, ক্ষতিকারক পদার্থ এবং সংক্রমণ এই সময়ে ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং বিকাশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি আপনার শিশুর জন্মগত ব্যাধি নিয়ে জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে ভ্রূণের বিকাশ 

যদিও আপনি বুঝতে পারবেননা, তবে প্রথম ত্রৈমাসিকে ভ্রূণের বেশ কিছু উন্নয়ন ঘটে। ত্রৈমাসিকের বিভিন্ন পর্যারে ভ্রূণের যে বিকাশ হয় তা হল-

গর্ভাবস্থার এক থেকে চার সপ্তাহ

গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো তৈরি হয়। এই কাঠামোগুলি কোষের একটি ক্ষুদ্র ঝাঁক, কিন্তু বড় হয়ে amniotic sac, placenta and umbilical cord এ রূপান্তর হবে। একটি টিউব যা ভ্রূণের মস্তিষ্ক, মেরুদন্ড এবং সংবহনতন্ত্রে পরিণত হবে। একটি অবয়বের মধ্যে বৃত্ত থাকে যা পরবর্তিতে চোখে রুপান্তর হবে এবং মুখের আকার নিতে শুরু করে। 
ভ্রূণটি প্রায় এক চতুর্থাংশ ইঞ্চি লম্বা হয়, যা চালের দানার চেয়েও ছোট।

গর্ভাবস্থার পাঁচ থেকে আট সপ্তাহ

গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ সপ্তাহে ভ্রূণের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, কান, বাহু এবং পা সহ বেশ কয়েকটি প্রধান অঙ্গের বিকাশ শুরু হয়। হাড়গুলি টিস্যু প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে। শরীরের অন্যান্য অংশের অনুপাতে ভ্রূণের মাথাটি বড় হয়, তবে এটি এখন আরও বেশি মানুষের মত দেখায়। ভ্রূণের একটি স্বতন্ত্র মুখ, নাক এবং মুখ রয়েছে। চিকিৎসক এই সময়ের মধ্যে একটি হৃদস্পন্দন নিশ্চিত করতে একটি প্রাথমিক আল্ট্রাসাউন্ড করেন।
গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহের শেষে, ভ্রূণটি প্রায় ১ ইঞ্চি লম্বা স্ট্রবেরীর সমান হয়।

গর্ভাবস্থার নয় থেকে বার সপ্তাহ

আপনার প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষের দিকে, ভ্রূণের পায়ের আঙ্গুল, গোড়ালি এবং নখ তৈরি হয়ে যায়। ভ্রূন নড়াচড়া করতে শুরু করে। হাত ও মুখ, বন্ধ এবং খুলতে পারে। ভ্রূণের প্রস্রাব এবং পাচনতন্ত্রও সম্পূর্ণরূপে কাজ করতে থাকে। ১২ সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ভ্রূণের হার্টিবিট শুনতে পারা যায়।
গর্ভাবস্থার ১২ তম সপ্তাহের শেষে, ভ্রূণটি ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা হয় যা প্রায় একটি বড়ইয়ের সমান। এটির ওজন প্রায় ১ আউন্স।

প্রথম ত্রৈমাসিকে লক্ষ্মণগুলো কি কি

আপনার প্রথম ত্রৈমাসিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে দেখে গর্ভবতী মনে হবে না, কিন্তু অনেক পরিবর্তন এর মধ্যেই ঘটতে শুরু করে দিয়েছে।আপনি যদি এর মধ্যে কোন চিকৎসক না দেখিয়ে থাকেন তবে খুব তাড়াতাড়ি চিকৎসকের সাথে যোগাযোগ করুণ। প্রাথমিক গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত পদক্ষেপ অনেক সম্ভাব্য জটিলতা এড়াতে সহায়তা করে। 
একজন গর্ভবতী মায়ের এইসময় সাধারণত যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় তা হল-
  • মায়ের স্তনের পরিবর্তন- প্রথম তিন মাসে মায়ের স্তনের আকার বড় এবং ভারী হতে শুরু করে। বেশি রক্ত সংবহনের জন্য আপনার স্তনের শিরাগুলি বাইরে দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
  • মর্নিং সিকনেস- এটি প্রাথমিক গর্ভাবস্থার অন্যতম লক্ষ্মণ। যদিও এর নাম মর্নিং সিকনেস, তবে এই ক্লান্তি সারাদিন, সারারাতও থাকতে পারে।
  • মুড সুইং- হরমোনাল পরিবর্তনের জন্য মায়েদের আবেগ আগের থেকে অনেক বেড়ে যায়। ৩০ মিনিট পর পর আপনার মধ্যে কান্না, ভয়, উদ্ব্যেগ বা রাগের মত আচারনের পরিবর্তন লক্ষ করবেন।
  • প্রস্রাবের চাপ- এইসময় আপনার জরায়ু বাড়তে শুরু করে। এটি আপনার মূত্রাশয়ের উপর চাপ দিতে শুরু করে, যার ফলে আপনার ঘন ঘন প্রস্রাব চাপ অনুভব করবেন।
  • ব্রণ- গর্ভাবস্থায় আপনার ত্বকে আরও তেল তৈরি হয়। এর ফলে কিছু ম্যায়ের ব্রণ হতে পারে।
  • অল্পতেই হাপিয়ে যাওয়া- প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভবতী মহিলারা অল্প কাজ করতেই হাপিয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

চিকিৎসকের সাথে কখন দেখা করা উচিত

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সাথে দেখা করা উচিত। তবে গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহের মধ্যে অন্তত একবার আপনার চিকিৎসকের সাথে দেখা করার সময় নির্ধারন করা উচিত। চিকৎসকের সাথে প্রথম সাক্ষাতের আগেই আপনি আপনার গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্ন এবং চিন্তার একটি লিস্ট তৈরি করে ফেলতে পারেন। 
আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে এবং ভবিষ্যতের গর্ভকালীন সময়ের দৈনন্দিন রুটিন কি হবে তা ঠিক করে নেওয়ার এখনই সঠিক সময়।

প্রথম ত্রৈমাসিকে আপনি কিভাবে নিজের যত্ন নিবেন

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক এ সুস্থ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থার প্রথম ১৩ সপ্তাহে সুস্থ থাকার জন্য এখানে কিছু সহায়ক টিপস দেওয়া হল-
  • যতটা পারেন সক্রিয় থাকুন। আপনার শরীরের কথা শুনুন এবং ব্যায়াম করার সময় আপনি যদি কোনো অস্বস্তি অনুভব করেন তবে বিশ্রামের জন্য থামুন। গর্ভাবস্থায় আপনার ব্যায়ামের রুটিন এবং পদ্ধতিতে পরিবর্তন করতে হতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়ামের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবেএ সময় ফলিক এসিড খাওয়া খুবই জরুরী।
  • ফল, সবজি, মাংস, ডিম এবং গোটা শস্য সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর খাবার খান
  • প্রচুর পরিমানে বিশ্রাম করুণ
  • প্রচুর পানি পান করুণ
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ঔষধ সেবন করুণ
  • বাইরে বের হবার সময় খেয়াল রাখতে হবে গর্ভবতী মায়ের যেন ঝাঁকুনি না লাগে
  • সমস্ত মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে স্বামীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। স্ত্রীকে আগের থেকে বেশি সময় দিতে হবে। তার প্রয়োজনীয় সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে কী করা উচিত নয়

একবার যখন আপনি জানতে পারেন যে আপনি গর্ভবতী, তখন আপনার জীবনধারার কিছু পরিবর্তন করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এই পরিবর্তনগুলি আপনার এবং বাচ্চার সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি এড়িয়ে চলা উচিত-
  • মদ্যপান এর অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে
  • সিগারেট এবং তামাক সেবন সম্পূর্ণরুপে পরিহার করতে হবে
  • ব্যাথানাশক ঔষধ খাওয়া যাবেনা। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
  • ফুটবলের মতো খেলাধুলা বা আপনার পেটে চাপ সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে
  • ক্যাফেইন জাতীয় খাবার যেমন চা, কফি ইত্যাদি কম খাবার অভ্যাস করতে হবে।

যেসব বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে

নিচের লক্ষনগুলি দেখা দিলে আপনাকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে-
  • গুরুতর পেট ব্যাথা হলে
  • ৩৮ (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে জ্বর আসলে 
  • প্রস্রাবে যন্ত্রণা দেখা দিলে
  • যোনিপথ দিয়ে রক্ত বের হলে
  • প্রস্রাবে জ্বালাযন্ত্রণা দেখা দিলে
  • প্রয়োজনাতিরিক্ত মাথা ঘুরালে

মন্তব্য

গর্ভাবস্থা আপনার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং কখনও কখনও ভীতিকর একটি সময়। গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে, আপনার শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরিবর্তন হয়। ভ্রূণও বৃদ্ধি পায় এবং বিকাশ লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে, প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষে, ভ্রূণটি একটি লেবুর আকারের হয়।

আপনি গর্ভবতী তা জানার সাথে সাথে দেরি না করে একজন ভাল চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুণ। গর্ভাবস্থায় আপনি এবং ভ্রূণ, সুস্থ এবং শক্তিশালী থাকার জন্য নিয়মিত প্রসবপূর্ব যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ধন্যবাদ
"সামরিন ইনফো"

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url