গরুর বিভিন্ন প্রকার রোগ ও চিকিৎসা

প্রাণীসম্পদ বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রানীসম্পদের মধ্যে গরু পালন কৃষি সমাজের বহুদিনের ঐতিহ্য। মানুষের যেমন বিভিন্ন রোগব্যাধি আছে, তেমনি এই গরুও রোগব্যাধির উর্ধে নয়। গরুর বিভিন্ন প্রকার রোগ এ যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থা যে অপূর্ননীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই পোষ্টে মূলত গরুর প্রচলিত রোগ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক গরু সাধারণত কি কি রোগে আক্রান্ত হয় এবং এসব রোগের জন্য একটি চাষিকে কি কি বিষয় মেনে চলতে হবে। 

ভুমিকা

গরুর মাংসের ও দুধের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষি পরিবার এর পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত যুবক, যুবতীরাও নিজ নিজ এলাকাতে গড়ে তুলছে গরুর খামার।এছাড়াও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও তৈরি করছে গরুর খামার এবং তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

তাই যথাযথ ভাবে গরুর রোগ নির্নয়, রোগের সঠিক চিকিৎসা এবং রোগ পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন অত্যন্ত জরুরী। তাই গরুরোগ সম্পর্কে কৃষক, খামারি ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সাধারন ধারনা থাকা বাঞ্ছনীয়।তাহলেই গরু সুস্থ থাকবে এবং সুস্থ গরু থেকে অধিক আয় সম্ভব হবে।

গরুর বিভিন্ন প্রকার রোগ

বাড়িতে বা খামারের পোষা গরু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখন আসুন এই রোগগুলি এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যাক।

একটি গরুর সচারচর যে রোগগুলি দেখা যায় তা হল-
  • খুরা রোগ
  • নিউমোনিয়া ও ঠান্ডা জনিত রোগ
  • ওলান পাকা রোগ
  • কৃমি রোগ
  • লাম্পি রোগ

খুরা রোগ

ইহা একটি সংক্রামক রোগ। সাধারনত “ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ” নামক ভাইরাসের কারনে এই রোগ হয়ে থাকে। যেহেতু এটা সংক্রামক রোগ তাই এর ভাইরাস আক্রান্ত এলাকা হতে ৬০-৭০ কিঃমিঃ এলাকাতে ছড়িয়ে পরতে পারে।

রোগের লক্ষন

  • গরু দূর্বল হয়ে পড়বে এবং খাওয়া বন্ধ করে দিবে।
  • গায়ের তাপমাত্রা ১০৪ ফারেনহাইট বা এর অধিক হবে।
  • খুর এবং জিহবাতে ঘা হবে।
  • মুখে লালা দেখা দিবে।
  • শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
  • ওজন কমে যাবে।

চিকিৎসা

  • প্রথমেই জ্বর কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে মুখে খাবার ঔষধ, প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিয়ে জ্বর কমাতে হবে।
  • আক্রান্ত গরুকে আলাদা যায়গায় রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • ক্ষত কমানোর জন্য ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খাবার ঔষধ, প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • একলিটার পানিতে ৫ গ্রাম সোডিয়াম বাই কার্বোনেট মিশিয়ে গরুকে দুইবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • কাঁচা হলুদ এবং সরিষার তেল অথবা সোহাগার খৈ এবং চিটা গুড় মিশিয়ে গরুর মুখের ভিতর জিহব্বা সহ চারিদিকে মাখিয়ে দিতে হবে। এভাবে যতদিন না ঘা নরম হয়ে ভাল না হয়ে যায় ততদিন এই ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারনত ৭-১০ দিনের মধ্যে ঘা ভাল হয়ে যায়।
  • প্রতিদিন ৪ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সোডিয়াম বাই কার্বোনেট মিশিয়ে পুরো গোয়ালঘর এবং গরুরু ক্ষুর ভালভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।

প্রতিরোধ

বাইরে থেকে গরু আনার পর কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ৬ মাস অন্তর অন্তর খুরার ভ্যাকসিন দিতে হবে।

নিউমোনিয়া ও ঠান্ডা জনিত রোগ

সাধারনত গরুর ফুসফুসের প্রদাহকেই গরুর নিউমোনিয়া বলা হয়। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দুইভাবেই একটি গরু নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

রোগের লক্ষন

  • শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। ১০২ ফারেনহাইটের উপর তাপমাত্রা থাকবে।
  • নাক দিয়ে পানি পড়বে।
  • দূর্বল হয়ে পড়বে এবং খাওয়া বন্ধ করে দিবে।
  • শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
  • অনেক সময় গরুর কাশি দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসা

  • প্রথমেই জ্বর কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে মুখে খাবার ঔষধ, প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিয়ে জ্বর কমাতে হবে।
  • ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খাবার ঔষধ, প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • মাথায় এবং শিং এ সরিষার তেল মাখালে এই রোগ থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

প্রতিরোধ

কোনভাবেই গরুকে স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা যাবেনা। স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিউমোনিয়ার প্রধান কারন।
অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে গরুকে রাখা যাবেনা।

ওলান পাকা রোগ

গরুর ওলান এর প্রদাহ বা ফোলা রোগকে ওলান পাকা রোগ বলা হয়। সাধারনত ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস বা ভাইরাসের কারনে এই রোগ হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণ

  • এই রোগের আক্রমনে গরুর ওলান লাল আকার ধারন করবে, ফুলে যাবে এবং শক্ত হয়ে যাবে।
  • ওলান এ হাত দিলে তা গরম অনুভব হবে।
  • শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
  • ওলান থেকে পুঁজ বা রক্তমিশ্রিত দুধ বের হতে পারে।
  • গরুর দুধ দেওয়ার পরিমাণ কমে যাবে।
  • গরুর খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে।

চিকিৎসা

  • দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক এবং ব্যাথার খাবার ঔষধ, প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • উষ্ণ গরম পানি দিয়ে নিয়মিত ওলান পরিষ্কার করতে হবে।
  • দিনে দুইবার সরিষার তেল দিয়ে ওলান এর বাট ম্যাসেজ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
  • পুরো খামার সোডা পানি দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

প্রতিরোধ

  • কোনভাবেই গরুকে স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা যাবেনা।
  • জীবানুমুক্তভাবে গরুরু দুধ সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • প্রতিনিয়ত গাভীর বাহ্যিক পরিক্ষার ব্যবস্থা যেমন তাপমাত্রা, জাবর কাটা, চোখার রঙ, চামড়ার রঙ ইত্যাদি এর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কৃমি রোগ

কৃমি একধরনের অন্তঃপরজীবী। গরুর দেহে বসবাস করে সেখান থেকেই খাবার গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। ফলে কৃমি গরুর খাদ্য হজমে সমস্যা তৈরি করে। অনেক কৃমি গরুর রক্ত শুষে নেয় এবং গরুকে দূর্বল করে ফেলে। যেহেতু আমরা গরুকে সাধারনত যে খাবার গুলো খাওয়ায় তা কখনই ধুয়ে দেওয়া হয় না। 

ফলে এর মধ্যে কৃমি থকার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে। সাধারনত এই খাবার থেকেই কৃমি রোগ ছড়িয়ে পরে। কৃমি সাধারনত গরুর ফুসফুসে, লিভারে, চোখে ও চামড়াতে বাস করে।

রোগের লক্ষণ

  • গরু দূর্বল হয়ে পড়বে এবং খাওয়া বন্ধ করে দিবে।
  • পেট ফাঁপা দেখা দিতে পারে।
  • স্বাস্থ্যের অবনতি হবে।
  • গোবর দুর্গন্ধযুক্ত হবে। পাতলা পায়খানাও হতে পারে।
  • দুধ দেওয়ার পরিমাণ কমে যাবে।

চিকিৎসা

  • ডাক্তারের পরামর্শে কৃমিনাশক মুখে খাবার ঔষধ বা ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • কৃমিনাশক ঔষধ দেওয়ার পর ৫-৬ দিন ডাক্তারের পরামর্শে লিভারটনিক খাওয়াতে হবে।

প্রতিরোধ

  • কোনভাবেই গরুকে স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা যাবেনা।
  • ময়লা মিশ্রিত খাবার গরুরকে না খাওয়ানো।
  • নিয়মিত ডাক্তার কে দিয়ে গরুকে চেক আপ এর ব্যবস্থা নেওয়া।

লাম্পি রোগ

ইহা মূলত একটি ভাইরাস জনিত রোগ। গরুর গায়ে ফোসকা দেখে এই রোগ চিহ্নিত করা যায়। এই রোগ খুব দ্রুত মশা বা মাছির মাধ্যমে একগরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রোগের লক্ষন

  • গরুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং খাবার রুচি কমে যাবে।
  • শরীরের তাপমাত্রা ১০৪-১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।
  • শরীরে জায়গায় জায়গায় লোম উঠে যাবে এবং ক্ষত দেখা দিবে। এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
  • গরু দূর্বল হয়ে যাবে এবং ওজন কমতে থাকবে।

চিকিৎসা

  • আক্রান্ত গরুকে খামার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।
  • দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
  • আক্রান্ত স্থানে কাঁচা হলুদ বাটা সরিষার তেলের সাথে মিশিয়ে মাখালে ভাল ফল পাওয়া যায়।
  • আক্রান্ত স্থান আয়োডিন মিশ্রন দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে।

প্রতিরোধ

বাইরে থেকে গরু আনার পর কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং লাম্পি ভ্যাকসিন দিতে হবে।

শেষ কথা

কৃষি ভিত্তিক এই গরু পালনে সফলতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই একজন খামারিকে গরুর এসব রোগ সম্পর্কে সম্মুখ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তা না হলে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অনেক সময় অবহেলাতে গরুর মৃত্যু খামারিকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। 

এই সংক্রান্ত আরও পোস্ট পেতে আমাদের পেজের গুগল নিউজ ফলো করে রাখতে পারেন।


ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url