খেজুর গুড় তৈরি এবং অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চেনার উপায়

হেমন্তের সোনালী ডানায় ভর করে শীত আসে ভিন্ন আমেজ নিয়ে। শীত মানেই যেন বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরির উৎসব। আর এই পিঠা তৈরিতে খেজুর গুড় এর ব্যবহার নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে অনেকেই হয়ত যানেনা কীভাবে এই খেজুর গুড় তৈরি হয়, আর যে গুড়টি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা আসল না ভেজাল আছে? তাহলে আসল খেজুর গুড় চেনার উপায় কি? 
খেজুর গুড় তৈরি এবং অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চেনার উপায়
আমাদের এই পোষ্টে মূলত খেজুর গুড় তৈরির পদ্ধতি এবং আসল খেজুর গুড় চেনার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চলুন যেনে নেওয়া যাক খেজুরের রস থেকে খেজুর গুড় তৈরি এবং অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চেনার উপায় গুলো কি কি।

ভূমিকা

শীতের সকালে আবহমান বাংলার আদি চিত্র গাছির খেজুরের রস পাড়া। সময়ের আবর্তনে আমাদের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে কিন্তু বাঙ্গালীর এই ঐতিহ্যটি যেন রয়ে গেছে আগের মতই। এখানে প্রকৃতির সাথে সবকিছুই যেন মেলান। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু আর আগের মত পৃথক করা যায় না। তারপরও গ্রামবাংলায় কোন কোন ঋতুর কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়।

যেমন শীত আসা মানেই খেজুরের রস এবং গুড়ের মিষ্টি আভা একএকটি জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই আভা ছড়ানর কাজ করে থাকেন ঐতিহ্যবাহি আর এক পেশার লোকজন, যাদেরকে বলা হয় গাছি। ফাল্গুন থেকে অগ্রাহায়ন মাস পর্যন্ত চলে এই রস তৈরির কাজ। সাধারণত কাক ডাকা ভোরেই রস পাড়া হয়। আর এই রস থেকেই তৈরি করা হয় খেজুর গুড়।

খেজুর গুড় এবং রস দুটোই আমাদের দেশের খুবই প্রচলিত সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে শহরের মানুষগুলো তো আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে কখন শীতকাল আসবে আর খেজুরের রস এবং গুড়ের পিঠা খাবে। তাই এর চাহিদা হিসাবে এটিকে আরও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব। এরফলে গ্রামের মানুষ গুলোও অর্থনৈতিকভাবে আরও লাভবান হবে।

তবে নৈতিকতার অবক্ষয় যেকোন ব্যবসার জন্য অত্যন্ত বিপদজ্জনক। সবাই যদি বেশি লাভের আশাতে গুড়ের মধ্যে ভেজাল যেমন-চিনি, ফিটকিরি ইত্যাদি মেশাতে শুরু করে তখনই হয়ে যায় মুশকিল। চাহিদা থাকা সত্তেও অনেক ভুক্তভোগীরা অরিজিনাল বা আসল খেজুরের গুড় চিনতে পারেননা আর এই গুড়ও কিনতে সাহস করেন না। তাই ব্যবসায়ীদের হতে হবে আরও নীতিবান এবং সৎ। আর ক্রেতাদেরকেও হতে হবে সচেতন।

খেজুর গুড়

খেজুর গুড় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান। এটি সাধারণত শীতের মৌসুমে তৈরি করা হয় এবং বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় এটি খুবই জনপ্রিয়। খেজুর গুড় তৈরি হয় খেজুর গাছের রস থেকে। রস সংগ্রহ করার পর সেটিকে ফুটিয়ে ঘন করা হয়, এবং সেখান থেকে তৈরি হয় খেজুর গুড়।

খেজুর গুড়ের প্রকারভেদ

  • পাটালি গুড়: এটি শক্ত এবং চৌকো বা গোল আকারে তৈরি হয়। এটি বেশিরভাগ সময় সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য উপযুক্ত।
  • নলেন গুড়: এটি তরল এবং অনেক বেশি সুগন্ধি। সাধারণত মিষ্টি জাতীয় খাবারে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • ঝোলা গুড়: এটি আধা তরল অবস্থায় থাকে এবং পিঠাপুলির জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়।

খেজুর গুড়ের পুষ্টিগুণ

  • ভিটামিন ও খনিজ: এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, এবং ম্যাগনেশিয়াম।
  • শক্তি বৃদ্ধি: এটি প্রাকৃতিক চিনির একটি চমৎকার উৎস, যা দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে।
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: খেজুর গুড়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
  • জম শক্তি বৃদ্ধি: এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।

খেজুর গুড়ের ব্যবহার

  • পিঠাপুলি: পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটায় এটি অপরিহার্য।
  • মিষ্টি খাবার: পায়েস, দই, মুড়ি-মুড়কিতে এটি ব্যবহার করা হয়।
  • নিয়মিত খাদ্য: চা বা রুটির সাথে এটি মধুর বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

সংরক্ষণ পদ্ধতি

খেজুর গুড় দীর্ঘদিন ভালো রাখতে চাইলে ঠান্ডা এবং শুকনো স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। নলেন বা ঝোলা গুড় সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ ব্যবহার করা ভালো।

বাংলাদেশের কোথায় কোথায় খেজুর গুড় পাওয়া যায়

বাংলাদেশের যশোরের খেজুর গুড় খুবই বিখ্যাত। তবে যশোর ছাড়াও ফরিদপুর, বাসিরহাট, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহীর নাটোর ইত্যাদি অঞ্চলেও ভাল মানের খেজুর গুড় পাওয়া যায়।

খেজুরের রস থেকে খেজুর গুড় তৈরি পদ্ধতি

রস সংগ্রহ

  • একটি খেজুর গাছের উচ্চতা সাধারণত ১৫-২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত অগ্রাহায়ন মাসের শেষের দিকে গাছ তোলা করা হয়। গাছের উপরের অংশের ডালপালা গুল চেঁছে পরিষ্কার করা হয়, একেই গাছ তোলা বলা হয়।
খেজুরের রস থেকে খেজুর গুড় তৈরি পদ্ধতি

  • এর একসপ্তাহ পর পুনরায় পরিষ্কার করা হয় এবং পরিষ্কার করা জায়গায় আধাহাতের মত বাকল তুলে ফেলা হয়। এরপর এখানে কেটে রস বের করা হয়। যদি রস বের না হয় তবে পরের দিন আবার কাটা হয়।
  • রস চলে আসলে সেখানে বাঁশের নল লাগিয়ে দেওয়া হয় যেন রস এই নল বেয়ে পড়তে থাকে। গাছের ছাল ছাড়ান অংশের একটু নিচে মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাঁশের নল দিয়ে রস এই হাড়ির মধ্যে জমা হয়।
  • সাধারণত সন্ধ্যার আগে এই হাড়ি ঝোলান হয় এবং সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর আর একটি হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা হতে পরের দিন সকাল পর্যন্ত রস দিয়েই সাধারণত আসল খেজুরের গুড় তৈরি করা হয়।
  • সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যে রস পাওয়া যায় সেটার মান সেরকম ভাল থাকেনা। এটি দিয়ে গুড় তৈর করলে গুড়ের মান ভাল হয় না।
  • শীত বেশি পড়লে রস ভাল হয়। আবহাওয়া গুমোট থাকলে রস একটু টক টক ভাব হয়।
  • একবার গাছে চাঁচলে সাধারণত ২ থেকে ৩ দিন রস সংগ্রহ করা যায়। আর একটি গাছ থেকে সাধারণত ৩ থেকে ৭ কেজি পর্যন্ত রস পাওয়া যায়।

খেজুর গুড় তৈরি

  • রসগুলো সংগ্রহের পর ভালভাবে ছেকে নিতে হয়।
  • এরপর দুই থেকে ৩ ঘন্টা জাল দিতে হবে। সাধারণত একটা চারকোনা পাত্রে এই রস জ্বাল দেওয়া হয়।
খেজুর গুড় তৈরি
  • রস জ্বাল দেওয়ার সময় একটু পর পর ফেনা জমতে থাকে। সেই ফেনা তুলে ফেলে দিতে হবে। রস ঘন হতে শুরু করবে এবং পরিমানেও কমতে থাকবে। সাধারণত ৮ কেজির রস জ্বাল দিয়ে ২ কেজি রসে আনতে হবে।
  • জ্বাল দেওয়া হয়ে গেলে একে একটি গোলাকার পাত্রে ঢেলে নিয়ে ৩০ মিনিট ধরে ঠান্ডা করতে দেওয়া হয়।
  • এরপর পাত্রের গায়ে লেগে থাকে গুড়কে, একটি চ্যাপ্টা কাঠের লাঠি দিয়ে পাত্রের গায়েই ঘষতে হবে। রঙ সাদা হয়ে যাবে। এই সাদা অংশকে বীজ বলা হয়। বীজ বানিয়ে তা আবার রসের মধ্যে নাড়া হয়। বীজ রসকে ঘন করে। এভাবেই তৈরি হয় খেজুর গুড়।
  • এরপর একে একটি নির্দিষ্ট ছাচের মধ্যে ফয়েল পেপার দিয়ে তার মধ্যে ঢালা হয়। এবং পরবর্তিতে বাজারজাত করা হয়।

অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চেনার উপায়

শীতের মৌসুমে বাজারে খেজুরের গুড় সহ আরও বিভিন্ন ধরণের গুড় পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে ভেজাল গুড়ের ভিড়ে আসল খেজুরের গুড় পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই হয়ত নিজের পরিচিত খেজুর গুড় তৈরির কারিগর দিয়েই খেজুর গুড় বানিয়ে আনেন। 

কিন্তু সবার পক্ষে তো আর এভাবে গুড় বানিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই কিছু কৌশল যানা থাকলে খুব সহজেই অরিজিনাল বা আসল খেজুরের গুড় চেনা যাবে।

আসুন যেনে নেওয়া যাক অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চেনার উপায়-
  • গুড় কেনার সময় প্রথমেই গুড়ের ধারগুলো আঙ্গুল দিয়ে চেপে দেখে নিতে হবে গুড় নরম কিনা। যদি নরম হয় তবে বুঝে নিতে হবে গুড়টা খুবই ভাল। এরমধ্যে অন্য কিছুর মিক্স নাই। সাধারণত চিনি মিশ্রিত থাকলে গুড় খুবই শক্ত হয়। হাইড্রোজেন বা ফিটকিরির ব্যবহারের ফলেও গুড় শক্ত হতে পারে।
  • গুড় খেয়ে দেখতে হবে। যদি কিছুটা লবনাক্ত মনে হয় তবে বুঝতে হবে এর মধ্যে ভেজাল আছে। এটি হয়ত অনেক পুরনো গুড়। গুড় যত পুরাতন হয় তার স্বাদে লবনাক্তের পরিমাণও বাড়তে থাকে।
  • বাহ্যিক ভাবে দেখতে হবে গুড়টি বেশি চকচকে কিনা। বেশি চকচকে হলে এর মধ্যে চিনি মিশ্রিত আছে। অনেকসময় খেজুরের রস খুব বেশি মিষ্টি হয়না। তখন মিষ্টি করার জন্য চিনি মিশ্রিত করা হয়।
  • সাধারণত বাদামি বা কালচে লাল রঙ এর গুড়ই হল অরিজিনাল বা আসল খেজুরের গুড়। আর হলদে রঙ এর খেজুরের গুড়ে ভেজাল আছে। অতিরিক্ত কেমিক্যাল মেশানর ফলেই গুড়ের রঙ হলদে হয়।

মন্তব্য

আশাকরি উপরের পোষ্টটি পড়ে আপনি অরিজিনাল বা আসল খেজুর গুড় চিনতে এবং তৈরিতে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন। তারপরও কোন মন্তব্য বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url