প্রোবায়োটিক কি, এর উপকারিতা এবং কি কি খাবারে প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়
বর্তমানে প্রোবায়োটিক খাওয়ার জন্য অনেক চিকিৎসকই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়ত এই প্রোবায়োটিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখিনা। প্রোবায়োটিক কি, এর উপকারিতা এবং কি কি খাবারে প্রোবায়োটিক পাওয়া যায় সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
তাই এই পোষ্টে মূলত প্রোবায়োটিক সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রোবায়োটিক কি
প্রোবায়োটিক হল জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট যা প্রানী বা মানব শরীরে উপকারী প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে পাচনতন্ত্রে। আমরা সাধারণত এগুলোকে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বলে মনে করি। কিন্তু প্রানী বা মানব শরীর ভাল এবং খারাপ উভয় ব্যাকটেরিয়া দ্বারাই পূর্ণ। প্রোবায়োটিকগুলিকে সাধারণত "ভাল" বা "সহায়ক" ব্যাকটেরিয়া বলা হয় কারণ তারা অন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
সাধারণত সাপ্লিমেন্ট এবং দইয়ের মতো কিছু খাবারে প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। ডাক্তাররা প্রায়ই হজমের সমস্যায় প্রোবায়োটিক যুক্ত সাপ্লিমেন্ট অথাবা খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিক এর মধ্যে পার্থক্য
প্রোবায়োটিক হল একধরণের উপকারী জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া। মানব দেহে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অবস্থান করে এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকারী ভূমিকা পালন করে। আর প্রিবায়োটিক হল এক ধরনের ফাইবার যা মানুষ হজম করতে পারে না, কিন্তু অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া তা হজম করতে পারে।
অর্থাৎ প্রোবায়োটিক হল উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা কিছু খাবার বা সাপ্লিমেন্টে পাওয়া যায় এবং প্রিবায়োটিকগুলি হল এক ধরণের ফাইবার যা পাচনতন্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য হিসাবে কাজ করে।
প্রোবায়োটিক কীভাবে কাজ করে
প্রানী বা মানব শরীরে প্রোবায়োটিকের বিভিন্ন ধরনের প্রভাব থাকতে পারে এবং বিভিন্ন প্রোবায়োটিক বিভিন্ন ভাবে কাজ করতে পারে-
- অনেক সময় শরীরের "ভাল" ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়, (উদাহরণস্বরূপ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করার পর)। তখন প্রোবায়োটিকগুলি তাদের প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করতে পারে।
- শরীরের কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য, প্রোবায়োটিক শরীরের "ভাল" এবং "খারাপ" ব্যাকটেরিয়াগুলির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
প্রোবায়োটিকের প্রকারভেদ
অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়াকেই প্রোবায়োটিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোর সবগুলরই বিভিন্ন ধরনের ভাল প্রভাব রয়েছে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই সাধারণত দুইটি গ্রুপ থেকে পাওয়া যায়-
- ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus)
- বিফিডোব্যাকটেরিয়াম (Bifidobacterium)
আর ইস্ট থেকে প্রাপ্ত প্রোবায়োটিক হল- Saccharomyces boulardii.
ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus)
এটি সবচেয়ে প্রচলিত প্রোবায়োটিক। সাধারণত দই এবং অন্যান্য গাঁজনযুক্ত খাবারে এটি পাওয়া যায়।এটি ডায়রিয়ায় এবং যারা ল্যাকটোজ হজম করতে পারে না তাদের জন্য উপকারী।
বিফিডোব্যাকটেরিয়াম (Bifidobacterium)
কিছু দুগ্ধজাত পণ্যে এটি পাওয়া যায়। সাধারণত Irritable Bowel Syndrome (IBS) এটি ভাল কাজ করে।
Saccharomyces boulardii.
এটি ডায়রিয়া এবং অন্যান্য হজম সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
প্রোবায়োটিক এর উপকারিতা কি
প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার খাওয়ার সুবিধাগুলো হল-
- অ্যান্টিবায়োটিক, অসুস্থতা এবং খারাপ খাবারের কারণে হারিয়ে যাওয়া ব্যাকটেরিয়া প্রতিস্থাপন করে সহায়ক ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ায়।
- অন্ত্রের আস্তরণ এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায়।
- ভিটামিন তৈরি করে এবং শরীরকে খনিজ শোষণ করতে সাহায্য করে।
- প্রদাহ হ্রাস করে এবং অ্যালার্জি এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করে।
- ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া হ্রাস করে অন্ত্রের গতিবিধি উন্নত করে।
প্রোবায়োটিকে কি কোন ঝুকি আছে
যাদের ইতিমধ্যেই পায়খানার সমস্যা আছে তারা হালকা গ্যাস বৃদ্ধি, ফোলাভাব বা হালকা ক্র্যাম্পিং লক্ষ্য করতে পারেন।
প্রথমেই অল্প পরিমাণ প্রোবায়োটিকযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং ধীরে ধীরে পরিমাণ বৃদ্ধি করা ভাল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে আপনার শিশু এই খাবারগুলি কত পরিমাণ সহ্য করতে পারে তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ রয়েছে। এর বেশি গ্রহণ করলে পার্শ্বপতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।
যদি আপনার সন্তানের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, তাহলে প্রোবায়োটিক দেওয়ার আগে চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।
প্রিবায়োটিক যুক্ত খাবার কি কি
অনেক উদ্ভিদ জাতীয় খাবারেই প্রাকৃতিকভাবে প্রিবায়োটিক পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু ফল, সবজি, মটরশুটি এবং শস্য জাতীয় খাদ্য অন্যতম। যেসব খাবারে প্রাকৃতিকভাবে প্রিবায়োটিক পাওয়া যায় সেগুলো হল-
- কাজুবাদাম
- কলা
- গম
- ভুট্টা
- রাই এবং বার্লি
- সয়া
- বাঁধাকপি
- কাঁচা রসুন
- কাঁচা/সিদ্ধ পেঁয়াজ
- মটর
- বেগুন
- শতমূলী
- ওট
- মটরশুটি
- মধু
প্রচলিত প্রোবায়োটিক যুক্ত ফার্মেন্টেড খাবার কি কি
সাধারণত ফার্মেন্টেড বা গাঁজনযুক্ত খাবারে প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। এই ধরনের বিভিন্ন রকমের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কারণ বিভিন্ন ধরণের ফার্মেন্টেড খাবার বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ করে।
উদাহরণ স্বরূপ কিছু ফার্মেন্টেড খাবারের নাম দেওয়া হল যেগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে প্রোবায়োটিক থাকে-
দই (Yogurt)
দই প্রোবায়োটিকের অন্যতম সেরা উৎস। প্রধানত ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া এবং বিফিডোব্যাকটেরিয়া দ্বারা ফার্মেন্টেড দুধ দিয়ে দই তৈরি করা হয়। দই এর উপকারিতাগুলো হল-
- হাড়, হার্ট এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল উন্নত করে।
- ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
- স্তন এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- ওজন কমাতে সাহায্য করে।
তবে মনে রাখতে হবে যে সমস্ত দইতে জীবিত প্রোবায়োটিক থাকে না। প্রক্রিয়াকরণ এর কারণে কখনও কখনও জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই কারণে, প্রক্রিয়াকরণের বিবেচনাতে দই কিনতে হবে।
কেফির (Kefir)
কেফির একটি ফার্মেন্টেড প্রোবায়োটিক দুধের পানীয়। এটি গরু বা ছাগলের দুধে কেফির দানা যোগ করে তৈরি করা হয়। কেফির দানাগুলি কোন খাদ্যশস্য নয় বরং ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্টের কালচার, যা দেখতে কিছুটা ফুলকপির মতো।
"কেফির" শব্দটি তুর্কি শব্দ "keyif" থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়, যার অর্থ খাওয়ার পরে ভাল বোধ করা।
কেফির সাধারণত-
- হাড়ের উন্নতি করে।
- হজমের সমস্যাতে সাহায্য করে।
- সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
- যাদের ল্যাকটোজ হজম হয়না তাদের জন্য কেফির একটি ভাল বিকল্প হতে পারে।
টেম্পেহ (Tempeh)
Tempeh হল একটি ফার্মেন্টেড সয়াবিন পণ্য। মূলত উচ্চ প্রোটিনের কারণে টেম্পেহ, মাংসের বিকল্প হিসাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর উপরকারিতাগুলো হল-
সয়াবিনে সাধারণত ফাইটিক অ্যাসিড বেশি থাকে, যা আয়রন এবং জিঙ্কের মতো খনিজগুলির শোষণকে বাধা দেয়। ফার্মেন্টেশনের ফলে এই ফাইটিক অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যায় এবং খনিজের মাত্রা বেড়ে যায়। ফার্মেন্টেশনের ফলে ভিটামিন বি-১২ তৈরি হয়, যা একটি সয়াবিনে থাকেনা।
যারা নিরামিষাশী তারা সাধারণত প্রানীজ ভিটামিন বি-১২ গ্রহণ করতে পারেনা। তাদের জন্য এই টেম্পেহ একটি ভাল বিকল্প।
শসার আচার (Cucumber Pickles)
শসাকে লবন দিয়ে জলীয় দ্রবনে তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে কিছু সময়ের জন্য ফার্মেন্টেড করা হয়।
শসার আচার স্বাস্থ্যকর প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার একটি ভাল উৎস, যা হজমের উন্নতি করে। এগুলিতে ক্যালোরিও কম এবং ভিটামিন কে-এর একটি ভাল উৎস, যা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য একটি অপরিহার্য পুষ্টি।
মনে রাখতে হবে যে, এর মধ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে এবং সাধারণত ভিনেগার দিয়ে তৈরি আচারে জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া থাকেনা।
ট্রেডিশনাল বাটারমিল্ক
"বাটারমিল্ক" বলতে আসলে ফার্মেন্টেড দুগ্ধ পানীয়কে বোঝায়। সাধারণত দুই ধরণের বাটারমিল্ক আছে-
- ট্রেডিশনাল বাটারমিল্ক
- কালচার বাটারমিল্ক
ট্রেডিশনাল বাটারমিল্কে প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। কালচার বাটারমিল্কে কোন প্রোবায়োটিক নেই। মাখন তৈরির পর অবশিষ্ট তরলকেই ট্রেডিশনাল বাটারমিল্ক বলা হয়। ট্রেডিশনাল বাটারমিল্কে ফ্যাট এবং ক্যালোরি কম থাকে, কিন্তু এতে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে, যেমন:
- ভিটামিন বি-১২
- রিবোফ্লাভিন
- ক্যালসিয়াম
- ফসফরাস
মিসো (Miso)
মিসো একধরণের ঘন পেস্ট যা লবণ এবং কোজি নামক একটি ছত্রাক দিয়ে সয়াবিনকে গাঁজন করে তৈরি করা হয়। বার্লি, চাল এবং রাইয়ের মতো অন্যান্য উপাদানের সাথে সয়াবিন মিশিয়েও মিসো তৈরি করা যেতে পারে। লোকেরা প্রায়শই এই পেস্টটি জাপানের একটি জনপ্রিয় ব্রেকফাস্ট খাবার "মিসো স্যুপে" ব্যবহার করে থাকে।
মিসো প্রোটিন এবং ফাইবারের একটি ভাল উৎস। এরমধ্যে ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ এবং কপার প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। মিসো ক্যান্সার, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের বিরুদ্ধেও কাজ করে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট
বাজারে বিভিন্ন ধরণের প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত ট্যাবলেট, পাউডার বা তরল ফর্মে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে জীবন্ত উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা ইস্ট থাকে। বাজারে যে প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায় সেগুলোর সবগুলোতে একই ধরণের ব্যাকটেরিয়া থাকেনা। বাজারে এমন অনেক পণ্য রয়েছে যার কার্যকারিতার প্রমাণ নেই।
কিছু প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট আছে যেগুলো আরও ভাল ফলাফলের জন্য, বৃহৎ অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া বহন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, আবার কিছু প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট হয়ত পাকস্থলির এসিড এরিয়াই অতিক্রম করতে সক্ষম নয়।
যাইহোক, প্রোবায়োটিকের সঠিক সাপ্লিমেন্ট কিছু লোকের জন্য অবিশ্বাস্যভাবে উপকারী হতে পারে। এটা নির্ভর করে সাপ্লিমেন্ট এর ধরন, সাপ্লিমেন্ট সূত্র, সাপ্লিমেন্ট গুণমান এবং স্টোরেজের উপর। তাই প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
মন্তব্য
সাধারণভাবে, প্রোবায়োটিক খাবার এবং সম্পূরকগুলি বেশিরভাগ লোকের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয়, যদিও কিছু মানুষের যাদের ইমিউন সিস্টেমের সমস্যা বা অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে তাদের এই প্রোবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয়।
কিছু ক্ষেত্রে, মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে পেট খারাপ হওয়া, ডায়রিয়া, গ্যাস এবং শরীর ফুলে যাওয়া অন্যতম। এগুলো এলার্জি বৃ্দ্ধিরও কারণ হতে পারে। তাই অবশ্যই প্রোবায়োটিক সেবনের পূর্বে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url