আম গাছের কীটনাশক স্প্রে করার নিয়ম

আম কে না ভালবাসে? বর্তমানে বাংলাদেশে অন্যতম জনপ্রীয় ফল হচ্ছে আম। সাধারণত গ্রীষ্মের সময় আম পাকার জন্য উত্তম সময়। তবে আমার মুকুল আসার পূর্ব হতে আম পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত অনেক ধরনের পোকা এবং বিভিন্ন ধরনের রোগজীবানু আমের ফলনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তাই এই সময় পোকা ও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে আম গাছের কীটনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন।
আম গাছে পোকা ও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কীটনাশক স্প্রে করার নিয়ম
আম গাছের কীটনাশক স্প্রে করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নিচে করা হল।

ভূমিকা

ফলের রাজ আম, বাংলাদেশে খুভ ভালভাবেই বিকাশ লাভ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলেই ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তবে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সবচেয়ে জনপ্রীয়। এই অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া আম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রধানত শীতের সময় আমের মূকুল আসা শুরু হয় এবং গ্রীষ্মকালে ফল পাকে।

আমের মুকুল সাধারণত লাল-হলুদ বর্ণের হয় এবং শীতের মাঝামাঝিতে মুকুল আসা শুরু হয়। সাধারণত জানুয়ারির শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে আমের মুকুল আসা শুরু হয়। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ফুলই একটি গাছে জন্মে। জলবায়ুর অবস্থার উপরই প্রধানত আমের মুকুল ফোটা নির্ভর করে। আমের মুকুল ফোটার সময়কাল ২০-২৫ দিন।

ফলের পরিমাণ গাছে সম্পূর্ণ ফুলের অনুপাত বা সংখ্যার উপর নির্ভর করে। প্রায় এক হাজারের মধ্যে মাত্র একটি বা দুটি ফুল পরিপক্ক ফল হতে পারে। একটি প্যানিকলে দুই থেকে তিনটি ফল, ভাল ফসল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আমার ফলন এর অন্যতম বাধা হল বিভিন্ন ধরনের পোকা, মাকড় এবং জীবানুর আক্রমণ। এসব থেকে রক্ষার জন্য কীটনাশক স্প্রে এর প্রয়োজনীয়তা অনেক। আম গাছের কীটনাশক স্প্রে করার সঠিক সময় এবং নিয়ম রয়েছে। এগুলো যথাযথ ভাবে পালন করতে পারলে ভাল ফলনের আশা করা যেতে পারে।

আম গাছের কীটনাশক স্প্রে করার নিয়ম

আম চাষের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ ও রোগ জনিত সমস্যা। এসব পোকা ও রোগের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে আম চাষ লাভজনক হবে না। আমের এইসব পোকা ও রোগ সম্পর্কে এবং এগুলো প্রতিরোধে কীটনাশক স্প্রে এর ব্যবহার নিচে আলোচনা করা হল-

হপার পোকা

সাধারণত কুয়াশা, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া এবং ঠান্ডা আবহাওয়াতে এই পোকার উপদ্রব দেখা দেয়। যেহেতু জানুয়ারির শেষের দিকে মুকুল আসার সময় আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, তখন এই পোকার উপদ্রব দেখা যায়। এই পোকাগুলো মুকুলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই পোকার ক্ষতিকর দিকগুলো হল-
  • হপার পোকা আমের মুকুল থেকে রস চুষে খেয়ে ফেলে। ফলে মুকুল গুলো শুকিয়ে যায়। পরবর্তিতে ঝরে পড়ে।
  • হপার পোকা তার দেহের ওজনের ২০ গুন বেশি রস মুকুল থেকে খেয়ে ফেলে। অতিরিক্ত রস মলদ্বার দিয়ে বের করে ফেলে। এই রস আঠালো হয়। এই রসের অপর নাম মধুরস বা হানিডিউ।
  • মধুরস পাতা এবং অন্যান্য মুকুলে জমা হয়। এখানে ছত্রাক জন্মায়, ফলে পাতা ও মুকুলের উপর কালো রঙের আস্তরন পড়ে। এই আস্তরন গাছের সালোকসংশ্লেষনে বাধাপ্রদান করে। ফলে গাছের আমের উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়।
Mango Hopper

প্রতিকার

  • যেহেতু হপার পোকা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকতে বেশি পছন্দ করে তাই, আম সংগ্রহের পরে ডালপালা ছাটাই করে আলো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • প্রতি ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার হারে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক, ১ মিলিলিটার হারে সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি এবং ২ গ্রাম হারে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ খুভ ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।

স্প্রে করার সময়

মুকুল আসার পূর্বে (সাধারণত ১০-১৫ দিন পূর্বে) একবার স্প্রে করতে হয়। এরপর ১৫ দিন পর আবার স্প্রে করতে হয়। এরপর পোকার আক্রমণের মাত্রার উপর বিবেচনা করে পরবর্তি স্প্রে করতে হবে।

ম্যাঙ্গো গল মিজ (Mango gall midge)

  • ম্যাঙ্গো গল মিজ হল একধরণের ক্ষুদ্র পোকা। এগুলো দেখতে অনেকটা মশার মত। এর লার্ভাগুলো হলুদ রঙের হয়। এরা সাধারণত গাছের টিস্যুর মধ্যেই ডিম পাড়ে।
  • গল মিজ লার্ভা গর্ত তৈরি করে পাতা বা মুকুলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে।
  • আক্রান্ত অংশ সাধারণত গোলাকার, ফোস্কা আকৃতির দেখতে হয়। এগুলোকেই গল (Gall) বলা হয়। এগুলো আনুমানিক ২-৩ মিমি ব্যাস এবং০.৪-0.৭ মিমি উচ্চ হয়। পাতার দুই পাশেই এগুলো দেখা যায়।
  • একই পাতায় বিভিন্ন রঙের গল (Gall) পাওয়া যায়।
  • প্রাপ্তবয়স্ক পোকা যখন গল (Gall) ত্যাগ করে, তখন এটি একটি ছোট প্রস্থান গর্ত করে।
  • পাতার টিস্যুতে ছিদ্র রেখে গল (Gall) গুলি শেষ পর্যন্ত পড়ে যায়।
  • আক্রান্ত মুকুল, পাতা আর বিকশিত হতে পারে না এবং ঝড়ে পড়ে যায়।
  • সংক্রমণের ফলে পাতার বিকৃতি হতে পারে, সালোকসংশ্লেষণ কমে যায় এবং পাতা ঝরে যায়, ফলে ফল উৎপাদন কমে যায়।
Mango gall midge

প্রতিকার

  • গাছের চারপাশের আগাছা কেটে সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
  • আক্রান্ত স্থান কেটে ফেলতে হবে।
  • মিশ্র ও আন্তঃফসল চাষ কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস করে।
  • প্রতি ১ লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম হারে Thiamethoxam গ্রুপের কীটনাশক, ১.৫ মিলিলিটার হারে Dimethoate গ্রুপের কীটনাশক, ২ মিলিলিটার হারে Lambda Cyhalothrin গ্রুপের কীটনাশক এবং ০.৬ গ্রাম হারে Imidacloprid গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ খুভ ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
  • সাধারণত ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

এনথ্রাকনোজ

Glomerella cingulata নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। অ্যানথ্রাকনোজ শব্দের অর্থ হল 'কয়লা'। ছত্রাকের আক্রমনের ফলে যে কালো দাগ পড়ে, এর উপর ভিত্তি করেই এনথ্রাকনোজ নামকরণ করা হয়েছে। ছত্রাক সাধারনত গাছের কচি পাতা, মুকুল এবং ফলে আক্রমণ করে। এই রোগের লক্ষনগুলো হল-
  • আক্রান্ত স্থানে প্রচুর পরিমাণে দাগ তৈরি হয়। দাগের উপর গুটি দেখা যায় এই গুটি গুলি বৃষ্টির দ্বারা অন্যান্য পাতা, ফুল এবং অংকুরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
  • প্রথমে, দাগগুলি ছোট, কালো এবং অসমান আকৃতির হয়। প্রায়শই প্রসারিত হয়ে বড় মৃত অঞ্চল তৈরি করে যা পরবর্তিতে শুকিয়ে যায় এবং পড়ে যায়।
  • কয়েকটি দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগ তৈরি করে।
  • পাতা বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হলে সালোকসংশ্লেষণে বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে পরবর্তিতে পাতা ঝরে যায়।
  • আমের মুকুল আক্রান্ত হলে কালো দাগ তৈরি হয় এবং পরবর্তিতে ফল আসার আগেই মুকুল ঝরে যায়।
  • আম ছোট থাকা অবস্থায় আক্রান্ত হলে, আমের উপরেও কালো দাগ পড়ে এবং পরবর্তিতে পরিপুষ্ট হওয়ার আগে আমও ঝরে যায়।
  • বড় আম আক্রান্ত হলে সাধারনত লক্ষণ প্রকাশ পায়না। তবে আম পাড়ার পর গুদামজাত করলে আবহাওয়া অনুকুলে পেলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
  • মেঘলা আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিতে এই রোগ দ্রুত বিস্তারলাভ করে।
Anthracnose of mango

প্রতিকার

রোগাক্রান্ত পাতা, আম, ডাল, মুকুল ছাটাই করে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
মুকুলে এই রোগ প্রতিরোধ করতে হলে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

স্প্রে করার পদ্ধতি

  • মুকুল ১০-১৫ সেমি বড় হলে স্প্রে শুরু করতে হবে। প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম মেনকোজেব বা ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
  • আম মটর দানার মত হলে ২য় স্প্রে করতে হবে।
  • এভাবে আম পাড়ার পূর্বে ১৫ দিন পরপর ৩/৪ বার স্প্রে করতে হবে।

আমের আঠা ঝরা বা গামোসিস রোগ

বর্তমানে আম গাছের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ হচ্ছে আঠা ঝরা বা গামোসিস রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে গাছে খুব কম সময়েই মারা যেতে পারে। বর্যাকালে এবং বর্ষার পরবর্তী সময়ে এই রোগের আক্রান্ত হার বেশি। প্রধানত Lasiodiplodia theobromae নামক ছত্রাকের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।

লক্ষণ

  • আম গাছের ডালে একটি আঠালো রসের মতো আঠালো পদার্থ নির্গত হয়। অনেকটা বাদামি রঙের মত।
  • আক্রান্ত ডাল এবং ছাল থেকে প্রচুর পরিমাণে আঠালো পদার্থ বের হয়।
  • আঠালো পদার্থটি গাছের ছালের উপর প্রবাহিত হয় এবং বাদামী থেকে কালো হয়ে যায় এবং বাকল বরাবর অনুদৈর্ঘ্য ফাটল দেখায়।
  • এই অনুদৈর্ঘ্য ফাটলগুলি শুকিয়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে পচে যায়।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে, এই রোগের কারণে আম গাছের মৃত্যু হতে পারে।
Gummosis of mango

প্রতিকার

  • এই রোগে আক্রান্ত মরা ডালপালা ছেটে ফেলতে হবে এবং পরবর্তিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম চুন ও ১০০ গ্রাম তুঁতে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে, আক্রান্ত স্থানে কিছু অংশ তুলে ফেলে প্রলেপ দিতে হবে।
  • গাছে নতুন পাতা দেখা দিলে, প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম মেনকোজেব বা ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।

বোঁটা পচা রোগ

সাধারণত আম পাড়ার পর এই রোগ দেখা যায়। পাকা আমে এই রোগ হয়। ছত্রাকজনিত কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। এই রোগের লক্ষনগুলো হল-
  • আম পাড়ার পর আমের বোটার গোড়ায় কালো বা বাদামি দাগ দেখা যাবে।
  • দাগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বোটার চারপাশে গোলাকার আকার ধারন করে।
  • আম ২-৩ দিনের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে যায়।

প্রতিকার

  • বৃষ্টির দিনে আম পাড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • বাগান সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
  • আম পাড়ার সাথে সাথেই ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভালভাবে শুকিয়ে বাজারজাত করতে হবে।
  • আম পাড়ার পুর্বে অর্থাৎ আম মটর দানার মত হলে, প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম মেনকোজেব বা ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।

কাল প্রান্ত রোগ

যেসব আম গাছ ইটের ভাটার কাছা কাছি অবস্থিত সেইসব আম গাছে এই রোগ হয়ে থাকে। ভাটার ধোয়া থেকে এই রোগ হয়। এর লক্ষনগুলো হল-
  • আম বোটার দিকে ভালভাবে বৃদ্ধি পায় কিন্তু নিচের দিকের বৃদ্ধি ভালভাবে হয়না। ফলে আমের গঠন ঠিকমত হয়না।
  • নিচের অংশ পচে যেতে পারে।

প্রতিকার

আম মটর দানার মত হলে প্রতি এক লিটার পানিতে ৫ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক পাউডার ভালভাবে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। এইভাবে ১৫ দিন পর পর আমার নামানোর পূর্বে ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।

মন্তব্য

আম চাষে বর্তমানে ভাল ফলন পেতে হলে আম গাছের কীটনাশক স্প্রে অত্যন্ত জরুরী। তবে খেয়াল রাখতে হবে স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে যেন আম পাড়া না হয়। কারণ এসব স্প্রের কার্যকারিতা সাধারণত ১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। স্প্রে করার সময় চাষীদের অবশ্যই চোখে চশমা এবং মুখে মাস্ক পরিধান করতে হবে। 

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url