কবুতরের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও চিকিৎসা
কবুতর একটি অতি জনপ্রিয় পাখি। কবুতরকে পোষ মানানো অনেক সহজ। কবুতর পালন করার আগে কবুতরের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে ভাল ভাবে ধারনা নিতে হবে। আজকে আমরা জানবো যে একজন কবুতর পালনকারীকে কবুতর পালন করার জন্য কি কি বিষয়ে অবগত থাকতে হবে।
আসুন আমরা জেনে নিই একটি কবুতর এর কি কি রোগ হয় এবং এর চিকিৎসা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি।
ভূমিকা
আদিম কাল থেকেই মানুষ কবুতর পালন করে আসছে। কবুতর পালনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কবুতরের রোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। বর্তমানে সকল বয়সী মানুষই সখের কারনে কবুতর পালন করে থাকে এর মূল কারণ হচ্ছে কবুতর এর বাহ্যিক সৌন্দর্য্য।
অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে কবুতর বানিজ্যকভাবেও পালন করে থাকে। কবুতর পালনে খুব একটা অতিরিক্ত খরচ নেই বললেই চলে এবং এটি পালনে অতিরিক্ত কোন জায়গার প্রয়োজন হয়না। অল্প জায়গাতেই অতি সুন্দর ভাবে কবুতর পালন করা যাই। কবুতরকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পোষ মানানো যায়।
বাড়ির আঙিনা বা বাড়ির ছাদে অথবা কার্নিশে খুব অল্প জায়গাতেই কবুতর পালন করা যায়। কবুতর পালনে বাড়ি ও পরিবেশের সৌন্দর্যবাড়ানো যায়। কবুতরের মাংস খেতে অত্যন্ত দারুণ এবং শরীরের বল বৃদ্ধিতে কবুতরের মাংস বেশ উপকারি। কবুতর মুরগীর থেকে অনেক বেশি রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হয়ে থাকে।
কুবতরের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও চিকিৎসা
বাড়িতে বা খামারের পোষা কবুতরের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কবুতর সচারাচর খুব কম রোগে আক্রান্ত হয়। এখন আসুন এই রোগগুলি এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।
একটি কবুতরের সাধারণত যে সকল রোগগুলি দেখা যায় তা হল-
- রাণীক্ষেত রোগ
- ফাউল কলেরা রোগ
- করাইজা অথবা আউল’স হেড
- ডিপথেরিয়া রোগ
- সালমেনেলোসিস/প্যারাটইফোসিস
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ একটি ভাইরাসবাহিত সংক্রমন রোগ। রাণীক্ষেত রোগে বেশিভাগ কবুতর মারা যায়। এই রোগ অতি দ্রুত সংক্রমন হয়।
কবুতরের রানীক্ষেত রোগের লক্ষণ
- রাণীক্ষেত রোগে আক্রান্ত কবুতর সারাদিন চুপচাপ বসে থাকবে এবং ঝিমাতে থাকে।
- আস্তে আস্তে খাদ্য গ্রহনের পরিমান কমে যাবে।
- দ্রুত ওজন কমতে থাকবে।
- প্রথম দিকে কবুতরের প্রচুর জ¦র আসবে।
- পাতলা পায়খানা করবে যা দেখতে চুনের মত সাদা দেখাবে।
কবুতরের রণীক্ষেত রোগের চিকিৎসা
- কবুতরের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমন যেন না হয় সেই জন্য কবুতরকে রেনামাইসিন, সিপ্লোসল ভেট ইত্যাদি যেকোন একটি ওষুধ খাওয়াতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কবুতরকে ভিটামিন সি জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে।
- রাণীক্ষেত রোগের জন্য কবুতরকে আরডিভি নামক ভ্যাকসিন দিতে হবে।
- কবুতরের পানির ঘাটতি মেটানোর জন্য ইলেক্ট্রোলাইট স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
প্রতিরোধ
কবুতরের বাসস্থান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কবুতরের ঘরে সব সময় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আলাদা কোন বাসা বা খামারের কবুতরের সাথে যেন না মিশে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সময়মত রাণীক্ষেত রোগের টিকা বা ভ্যাকসিন দিতে হবে।
কবুতরের ফাউল কলেরা রোগ
ফাউল কলেরা রোগ যাকে এভিয়ান প্যারামিক্সোভাইরাস নামেও পরিচিত। এই রোগটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমন এর কারনে হয়ে থাকে।
কবুতরের ফাউল কলেরা রোগের লক্ষণ
- ফাউল কলেরা রোগের কারনে কবুতরের শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা যায়।
- কাশি, হাঁচি, নাক দিয়ে পানি পড়বে।
- বমি ও ডায়রিয়া দেখা দিবে।
- পাখা বা ডানাগুলোর মধ্যে কম্পন দেখা দিতে পারে।
- কবুতর অলস হয়ে যাবে, দ্রæত ওজন কমতে থাকবে।
কবুতরের ফাউল কলেরা রোগের চিকিৎসা
- কলেরা রোগে সালফার ড্রাগ প্রয়োগ করা যায়।
- অ্যান্টিভাইরাল বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
- নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে।
প্রতিরোধ
কবুতরের কলেরা রোগটি ভাইরাস জনিত রোগ হওয়ার কারনে সংক্রমন রোধে সুস্থ কবুতর থেকে আলাদা রাখতে হবে। হাইড্রেশন ও সঠিক পুষ্টি জাতীয় খাদ্য খাওয়াতে হবে। জৈব নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কবুতর থাকার জায়গাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
করাইজা অথবা আউল’স হেড
করাইজা বা আউল’স হেড রোগটি মূলত ব্যাকটেরিয়া জনিত একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগটির অনেক নাম রয়েছে যেমন- Cold, Catarrh, Infectious Roup ইত্যাদি।
লক্ষণ
- কবুতরের প্রথমে মুখ, মাথা ও চোখ আস্তে আস্তে ফুলে যাবে।
- কবুতরের নাক ও মুখ দিয়ে তরল জাতীয় পদার্থ বের হবে।
- চোখ বন্ধ হয়ে যাবে এবং ফুলে যাবে।
- নিঃশ্বাস গ্রহন করতে খুব কষ্ট হবে এবং ঘরঘর শব্দ করবে।
- খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে।
- গলোদেশ ফুলে যাবে এবং হাচি হবে।
চিকিৎসা
- প্রতিদিন দুই বার করে ভিনেগার মিশ্রিত পানি দিয়ে চোখগুলি ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে।
- কবুতরকে সুপার টি এস প্রতি ৫ লিটার পানিতে ১ গ্রাম মিশ্রণ করে ৩ থেকে ৫ দিন খাওয়াতে হবে।
- মাইক্রোনিড প্রতি ১ লিটার পানিতে ০.৫ থেকে ১ গ্রাম মিশ্রণ ৩ থেকে ৫ দিন খাওয়াতে হবে।
প্রতিরোধ
নিরাপত্তার জন্য খামারের সবসময় স্বাস্থ্যসম্মত রাখার নিয়মগুলি পালন করতে হবে। এই রোগটি প্রতিরোধ করার জন্য সময় মতো টিকা বা ভ্যাকসিন দিতে হবে। যার দ্বারা এই রোগটি হয় সেই মাধ্যমগুলি এড়িয়ে চলতে হবে। এতো কিছু করার পরও কবুতর আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাহলে সাথে সাথে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
কবুতরের ডিপথেরিয়া রোগ
কবুতরের ডিপথেরিয়া রোগ একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। Corynebacterium Diphtheriae নামক ব্যাকটেরিয়া এর রোগের মূল উৎস। এই রোগটি সকল বয়সী কবুতরের হয়ে থাকে তবে শিশু বা ছোট কবুতরগুলি বেশি আক্রান্ত হয়ে এই রোগে। ধুলো, পানি, বায়ুর মাধ্যমে এই রোগটি বেশি ছড়ায়।
কবুতরের ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ
- কবুতরের নাক, মুখ দিয়ে অনবরত পানি পড়বে।
- কবুতরের শ্বাস প্রশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হবে।
- শরীরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বেড়ে যায় ফলে জ¦র জ¦র অনুভব করে।
- খাদ্য খেতে অনেক কষ্ট হয়ে যার ফলে খাদ্য মুখে নিয়ে আবার ফেলে দেই।
- কবুতরের প্রচুর কাশি হয় অনেক সময় কাশির সাথে রক্ত বের হতে দেখা যায়।
- কবুতরের পায়খানা হালকা সবুজ বা সাদা রং এর মতো দেখা যায়।
কবুতরের ডিপথেরিয়া রোগের চিকিৎসা
- এই রোগের প্রথম এবং প্রধান ওষুধ হলো এন্টি-টক্সিন যা কবুতরকে দিতে হবে।
- এছাড়াও এন্টি-টক্সিন ছাড়া এন্টিবায়োটিকও প্রয়োগ করা যায়।
- বেশি রোগ আকার ধারণ করলে অতি তাড়া তাড়ি চিকিৎসকরে নিকট নিয়ে যেতে হবে।
কবুতরের ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিরোধ
ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিরোধের জন্য সর্ব প্রথম কবুতরের ঘর খোলা মেলা জায়গায় স্থাপন করতে হবে। প্রতিদিন কবুতরের খাবার ও পানির পাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সকল প্রকার পোকামাকড়, ইঁদুল, বিড়াল যেন কোন ভাবেই কবুতরের ঘরে প্রবেশ করতে না পারে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সালমেনেলোসিস/প্যারাটইফোসিস
কবুতরের সালমেনেলোসিস রোগটি অতি পরিচিত একটি রোগ। প্রায় সকল কবুতরের এর রোগটি হয়ে থাকে। এটি মূলত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ। এই ব্যাকটেরিয়া ১ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে।
লক্ষণ
- কবুতরের মল আঠার মত সবুজ রঙের চুনার মত দেখা যাবে এবং মলে প্রচুর দুর্গন্ধ বের হবে।
- কবুতর খাদ্য গ্রহন প্রায় কমিয়ে দিবে এবং বমি করবে। অনেক সময় কবুতরের পায়ুপথে পায়খানা লেগে থাকে।
- সালমেনেলোসিস এর কারনে কবুতর এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে এবং ঝিমাতে থাকবে।
- কখনও কখনও কবুতরের পা ও পাখা প্যারালাইজড হয়ে যায়।
চিকিৎসা
- ভেটেনারি মেডিসিন অনুযায়ী ইরোকট পাউডার আক্রান্ত কবুতরকে ১ গ্রামের ৪ ভাগের ১ ভাগ পানিতে মিশিয়ে ১ দিনে তিন বার খাওয়াতে হবে।
- এই রোগ হলে কবুতরকে শক্ত খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ভিটামিন সি এর জন্য লেবুর রস পানিতে মিশিয়ে ২/১ দিন খাওয়াতে হবে।
প্রতিরোধ
কবুতরের রোগ প্রতিরোধের আগে সঠিক রোগটি সনাক্ত করতে হবে। সঠিক রোগ সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলে কবুতরকে বাঁচানো সম্ভব নাই বললেই চলে। অনেক ভাবেই কবুতরের সালমোনেলা রোধ করা যায়। আনফিল্টারড আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার সবথেকে কার্যকরী।
প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলি আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে সেই পানি কবুতরকে খাওয়ালে এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে। কবুতরের খাবার কিছুক্ষণ গরম অথবা পটাশ মেশানো পানি দিয়ে কবুতরের খাবার ধুয়ে খাওয়ালে কবুতরের এই রোগটি হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে। কবুতরকে পরিষ্কার পানি খাওয়াতে হবে। কবুতরের থাকার জায়গা সপ্তাহে ১/২ বার পরিষ্কার করতে হবে।
মন্তব্য
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে কবুতর পালন শখের একটি জিনিস। তাই কবুতরকে সুস্থ রাখার জন্য অবশ্যই কবুতরের রোগ, চিকিৎসা সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতে হবে। উপরোক্ত আলোচনায় একজন কবুতর পালনকারী সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url