পহেলা বৈশাখের ইতিকথা এবং ১০টি বাক্য

যারা পহেলা বৈশাখ এর ইতিকথা জানতে আগ্রহী এবং এই পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে ১০টি বাক্য খুজছেন এই পোষ্টটি তাদের জন্য।
https://www.samreeninfo.com/2024/01/valentines-day.html
চলুন জেনে নেওয়া যাক পহেলা বৈশাখের ইতিকথা এবং পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে ১০টি বাক্য।

পহেলা বৈশাখের ইতিকথা

আসলে পহেলা বৈশাখ এখন যেমন করে উৎসব মুখরিত পরিবেশে পালন করা হয় আগেও কি এমন ছিল? না। আগে মোটেও এমন ছিল না। এমন করে শুরু হয়নি পহেলা বৈশাখ। মূলত খাজনা আদায়ের মাধ্যমে এ পহেলা বৈশাখ শুরু হয়েছিল। সম্রাট আকবরের আমল অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ অথবা আরবি হিজরী ৯৯২ থেকে মূলত বাংলা সাল শুরু হয়। তখন পয়লা বৈশাখ ছিল না। 

তখন চাষিরা জমিদারের থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত এবং খাজনা স্বরূপ চাষের ফসলের অর্ধেকের বেশি দিয়ে দিতে হতো, যেহেতু কৃষকদের কাছে জমি চাষের ছিল না এ কারণে তারা বর্গা নিয়ে চাষ করত। এই খাজরা নেওয়ার দিনটাতে জমিদাররা চাষীদের মিষ্টিমুখ করানোর জন্য একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান করত যার নাম ছিল " পূন্যাহ "। 

এই অনুষ্ঠানটিই পরবর্তী রূপ হল হালখাতা,বিভিন্ন ধরনের মেলা এবং পরবর্তীতে এখন পহেলা বৈশাখ। তবে আগেকার দিনে এই অনুষ্ঠান শুধু খাজনা আদায়ের দিন হলো বর্তমানে আমরা এই দিনটি উদযাপন করি নতুন জামা কাপড় পড়ে এবং ইলিশ পান্তা খেয়ে।

পহেলা বৈশাখের প্রবর্তনকারী কে?

সম্রাট আকবর যেহেতু বাংলা দিনপঞ্জিকা আবিষ্কার করেন এবং তখন থেকেই এই খাজনা আদায়ের রীতিনীতি বা অনুষ্ঠান যেহেতু আস্তে আস্তে শুরু হয় সেজন্য পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক হিসেবে আমরা সম্রাট আকবর কেই জেনে থাকি।

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ

সব দেশের নববর্ষ উদযাপন হয়। তবে একেকটা দেশে এক এক রকম ভাবে এ উৎসব পালন করা হয়। যেমন বাংলাদেশের তিন রকম নববর্ষ পালন হতে দেখা যায়। একটি হলো ইংরেজি বছরের শুরু যা ৩১ এর ডিসেম্বর রাত বারোটার পর পালন করা হয় অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি। আরবি হিজরী বা রবিউল আউয়াল যেমন শুরু হয় মাগরিবের আজানের পর থেকেই।

আর বাংলায় বছরটা শুরু হয় পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ ১৪ই এপ্রিল ভোরের সূর্য উদয় দিয়ে। বছর শুরুর সময় টা যেমনই হোক না কেন সবাই নতুন বর্ষকে বরণ করে পুনর্জনম,নবজন্ম বা পুরোনো হতাশার গ্লানি বিদায় দিয়ে নতুন সুন্দর জীবন বা জীবনের প্রবেশ করার আশা নিয়ে।

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ দিনটির আশ্বাস

এ দিনটি অন্যদিনের মতোই সাধারণ। একইভাবে অন্যদিনের মতোই পাখি গান গায়, নদী বয়ে যায়, গাছপালায় শোনা যায় পাখির কলরব, সবার জীবন যাপন চলতে থাকে একই ছন্দে। তবুও ঠিক কেমন যেন একটি স্বতন্ত্রতা বা বৈশিষ্ট্য দেখা যায় এই দিনটিতে। এই দিনকে মনে হয় যেন গতবছর থেকে নতুন বছরের শুরুতে মুক্তির বার্তাবাহক। 

মনে হয় আজকে থেকে সবকিছুই যেন নতুন করে শুরু হতে চলেছে,নতুন আশা, নতুন রূপ এমন। হৃদয় মনে হয় কোন এক অসীম আনন্দের দিকে ধেয়ে চলেছে, নতুনকে বরণ করে নেওয়ার একটি সুন্দর প্রয়াসে।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদযাপনের বৈশিষ্ট্য

  • অতীতের সুখ-দুঃখ গ্লানি হতাশা ভুলে নতুন করে শুরু করে উযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বাংলাদেশে। 
  • বাংলাদেশের মানুষ জন তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে পছন্দ করে। 
  • বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষকেই দেখা যায় এই দিন নতুন শাড়ি কাপড় পরে দিনটি বরণ করতে। 
  • বাংলাদেশের এই দিন বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা বসে।
  • সকাল সকাল সবাই সূর্য উদয়ের সঙ্গে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মঙ্গল শুভযাত্রার আয়োজন করে থাকে।
  • প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সবাই মিষ্টিমুখ করাতে পছন্দ করেন।
  • বাংলাদেশের এই দিনটির গুরুত্ব এতই বেশি যে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
  • বহু জায়গায় ছোট ছোট করে অনুষ্ঠান পালিত হয় এবং হালখাতাও হয়।

গ্রামীণ জীবনে পহেলা বৈশাখ 

গ্রামের মানুষের কাছে দিনটি তাৎপর্য অনেক বেশি এবং গ্রামীণভাবেই প্রথমে শুরু হয়েছিল এই পহেলা বৈশাখ। বেশ বর্ণাঢ্যভাবেই পল্লী অঞ্চলের কোথাও কোথাও মেলা বসে। এসব মেলাতে প্রচুর কেনাকাটা বেচা বিক্রি হয়। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়,যাত্রাপালা হয়, মঞ্চ নাটক হয় এবং অনেক ধরনেরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

নগর জীবনে পহেলা বৈশাখ

শুধু যে গ্রামীণ জীবনেই পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় তা না আজকাল নগর জীবনও বেশ জাঁকজমক ভাবেই পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে। নতুন বছরকে আগমন জানানোর জন্য হয়তো নগরের কোন বড় লেকের ধারে অথবা খুব বড় কোন গাছের নিচে সমবেত হয় অনেকগুলো লোকজন বেশ আনন্দের সাথে। 
সূর্য ওঠার সাথে সাথে সবাই খুব ভোর ভোর বেশ আনন্দ ভরেই বরণ করেন পহেলা বৈশাখ কে। শিল্পীরা তাদের মতো করে সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন। অনেক জায়গায় শিশুদের বা বড়দেরও নাচের অনুষ্ঠান দেখা যায়। এদিন নগর জীবনে দেখা যায় সবাইকে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়তে। 

নারীরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে চুলের খোপাতে সুন্দর করে ফুল পড়ে হাতে একগাদা চুড়ি পড়ে কপালে সুন্দর টিপ পড়ে খুব সুন্দর করেই সেজেগুজে থাকেন এই দিনটিতে। সে ক্ষেত্রে ছেলেরাও পিছিয়ে নেই কোন ভাবেই ছেলেরাও খুব সুন্দর পাঞ্জাবি পড়ে থাকেন এই দিনে, বেশিরভাগ ছেলে দেখেই দেখা যায় সাদা পাঞ্জাবি পড়তে। 

নগর জীবনে আজকাল যেন ফ্যাশনই হয়ে গেছে পহেলা বৈশাখের দিন ইংলিশ পান্তা খেতেই হবে। তবে বাংলাদেশের অনেকেই হয়ত পহেলা বৈশাখের ইতিকথা না জেনেই উৎসবে অংশগ্রহন করেন। 

বৈশাখী মেলা

বৈশাখী মেলা হলো পহেলা বৈশাখের এখন একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন লোকজ পণ্য,কুটির জাত পণ্য,হস্তশিল্প, মৃত শিল্প, কুটির শিল্প নিয়ে তৈরি হয় এই মেলাগুলো। এখানে পাওয়া যায় নানান ধরনের নানান রকমের পণ্য। বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে মেয়েদের সাজুগুজু করার জিনিস,ঘর সাজানোর জিনিস,সবকিছুই পাওয়া যায় যেন এই পহেলা বৈশাখের বৈশাখী মেলাতে।। 

মেলাতে চলতে থাকে বিভিন্ন ধরনের যাত্রা, পালা গান,কবি গান, সারি গান বা ভাটিয়ালির মত গান। নাগরদোলা ছাড়া তো বৈশাখী মেলা যেন কল্পনাই করা যায় না পুতুল নাচ,সার্কাস, নাটক প্রদর্শনী এসবও হয় বাংলাদেশের বৈশাখী মেলাতে।

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সরকারি ছুটির দিন 

বাংলাদেশ সরকার পহেলা বৈশাখ কে বা নববর্ষের দিনটিকে বাঙালির প্রাণের উৎসব মনে করেন আর এই কারণেই এই দিনটিতে সকল ধরনের অফিস আদালত প্রতিষ্ঠান স্কুল কলেজ সবকিছুই বন্ধের ঘোষণা করা হয়েছে অর্থাৎ সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছে। যেন সবাই খুব উৎসব মুখরিত হয়েই এই দিনটি নিজের পরিবারের সাথে বন্ধু-বান্ধবের সাথে উপভোগ করতে পারেন। 

শুধু বাংলাদেশেই নয় এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পহেলা বৈশাখ কে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষে জাতীয় কর্মসূচি

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ জাঁকজমক ভাবেই পালন করে থাকে পহেলা বৈশাখ। নজরুল ইনস্টিটিউট,শিল্পকলা একাডেমী,জাতীয় জাদুঘর,বাংলা একাডেমি,বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট ইত্যাদি সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
" যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার "

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অন্য কবিতায় আরো বলেছেন
"এসো এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাস্য বায়ে মুমূর্ষুর দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক "

নতুন বছর সম্পর্কে আলফ্রেড টেনিসন বলেছেন
" রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ
রিং হ্যাপি বেলস, এক্রস দি স্নো
দিয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো
রিং আউট দি ফলস, রিং ইন দি ট্রু "

পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে ১০টি বাক্য

নিচে পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে ১০টি বাক্য দেওয়া হল-

১. সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন এবং তখন থেকেই বৈশাখ মাসের ১ তারিখে পালন করা হয় নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ।

২. সাধারণত ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪ ই এপ্রিল বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন করা হয় এবং ১৫ ই এপ্রিল ভারতে এ উৎসব পালন করা হয়।

৩. বাঙালি জাতির একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ।

৪. পহেলা বৈশাখে অনেকেই তাদের দোকানে হালখাতা উদযাপন করে সে ক্ষেত্রে হালখাতার দিনে যে যার ব্যবসায়ের বকেয়া গুলো কিছুটা হলেও তুলতে সক্ষম হয় এবং নতুন করে নতুন হিসাবের খাতা করে।

৫. পহেলা বৈশাখের দিন আসলে বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলাও বসতে দেখা যায়।

৬. বাঙালিরা এই দিনটির সকালে পান্তা ভাত, সাথে ইলিশ মাছ ও রকমারি ভর্তা দিয়ে দিন শুরু করতে পছন্দ করে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে আবার দই চিড়া দিয়েও সকালটি শুরু করার প্রথা দেখা যায়।

৭. পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের সকালবেলা যেন মঙ্গল শুভযাত্রার মাধ্যমেই মুখরিত হয়ে থাকে এবং লোকসংগমে হাতে হাতে পুতুল,মুখোশ,ঘোড়া,পাখি,বিভিন্ন ধরনের রংবেরঙের ছড়া গান লেখা পোস্টার নিয়ে গ্রাম বা শহর যেন গম গম করে।

৮. মঙ্গল শুভযাত্রাকে ইউনেস্কো " মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য "হিসেবে ঘোষণা করে।

৯.পহেলা বৈশাখ উৎসবটি হল বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন গোত্রের সবার একত্রিত হওয়ার একটি উৎসব।

১০. আমি একজন বাঙালি হিসেবে পহেলা বৈশাখ হল আমার কাছে আমার প্রাণের উৎসব।

মন্তব্য

পহেলা বৈশাখের ইতিকথা এবং ১০টি বাক্য সম্পর্কিত উপরের পোষ্টটি ভাল লেগে থাকলে, কিংবা কোন মন্তব্য থাকলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুণ। 

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url