প্রথম পাতাল রেল এর যুগে বাংলাদেশঃ বিস্তারিত আলোচনা
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি প্রস্তাবিত ভূগর্বস্থ শহুরে রেল নেটওয়ার্ক হচ্ছে ঢাকা পাতাল রেল বা মেট্রোরেল। মূলত এটি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত। এটি ঢাকার তীব্র যানজট নিরসনের জন্য সময়োপযোগী একটি যুগান্তকারী প্রকল্প। "প্রথম পাতাল রেল এর যুগে বাংলাদেশঃ বিস্তারিত আলোচনা"- পোষ্টে এই যুগান্তকারী প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আজকে আমরা জানবো বাংলাদেশের এই গৌরবময় পাতাল রেল সম্পর্কে।
ভূমিকা
কত ইতিহাস, কত দীর্ঘশ্বাস, কত স্বপ্ন, কত আনন্দ বেদনা সব কিছুর গল্প বুকে নিয়ে টিকে আছে আজও এই শহর। ১৯৭৪ সালে ১৬ লাখ জনসংখ্যা ছিল এই ঢাকা শহরে। বর্তমানে ঢাকায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বসবাস করে তবে দিন দিন এই মানুষের পরিমান বাড়তেই আছে। এই ভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী ২০৩৫ সালে রাজধানী ঢাকাতে মোটামুটি সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা হয়ে দাঁড়াবে।
এই বিপুল জনসংখ্যার ঢাকার যানজট ও ট্রাফিক সমস্যা দূর করার জন্য পাতাল রেল হলো একটি যথোপযুক্ত গ্রহণযোগ্য প্রকল্প। বিশ্বের জনবহুল মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ঢাকাই হলো সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ঢাকার বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে পাতাল রেল হতে পারে একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা।
পাতাল রেল কি
ঢাকার মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো স্পর্শ করে গনপরিবহনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ভুগর্ভস্থ রেল লাইন নেটওয়ার্ক ই হলো পাতাল রেল। এর মাধ্যমে মানুষ দ্রতগতিতে, আরামে ও নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতাযাত করতে পারবে। ঢাকার মেট্রো রেল এবং পাতাল রেল দুইটি আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ পরিবহন ব্যবস্থা।
পাতাল রেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন
২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ইং তারিখে বেলা ১১টায়, রূপগঞ্জের জনতা উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন রাজউকের কমার্শিয়াল প্লট মাঠে, দেশের প্রথম পাতাল রেলপথের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাতাল রেল প্রকল্প
- বর্তমান ও ভবিষ্যত চিন্তা করে বসবাসযোগ্য রাজধানী গড়ে তুলার জন্য গ্রহন করা হয়েছে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। ইংরেজীতে যাহাকে বলা হয় ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা সংক্ষেপে ড্যাপ। এই ড্যাপের সময় কাল হলো ২০ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত।
- ঢাকা নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার প্রায় ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে তুলতে যাচ্ছে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বসবাসযোগ্য এক মেগাসিটি এই সব কিছুই থাকবে এই ড্যাপে। রাজউকের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকার সীমানা হলো- উত্তরে সমগ্র গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা, দক্ষিণে নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা যা ধলেশ্বরী নদী দ্বারা বেষ্টিত, পশ্চিমে সাভারের বংশী নদী এবং পূর্বে কালীগঞ্জ-রূপগঞ্জ যা শীতলক্ষ্যা নদী এবং দক্ষিণ পশ্চিমে কেরানীগঞ্জ দ্বারা বেষ্টিত।
- আর এই বিশাল অঞ্চলকে মেট্রোরেলের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী উড়ালে পাতালে পুরো রাজধানী ও রাজধানীর আশে পাশের অঞ্চলকে এক সাথে করতে তৈরী করা হচ্ছে ৬ টি মেট্রোরেল লাইন। এই গুলি হল MRT Line-1, MRT Line-2, MRT Line-3, MRT Line-4, MRT Line-5, MRT Line-6. এগুলোর দৈর্ঘ্য হবে ১২৮ কিলোমিটার।
- এর মধ্যে থাকছে ১০৪ টি স্টেশন। এরমধ্যে উড়াল স্টেশন হবে ৫১টি এবং পাতাল রেল স্টেশন হবে ৫৩টি। এই ৫৩টি স্টেশন নিয়ে মাটির নিচে তৈরি হচ্ছে আরেকটি নতুন ঢাকা। এই ৬টি লাইন এর মধ্যে MRT Line-2 যেটি সাভার ইপিজেট থেকে শুরু করে কমলাপুর পর্যন্ত যাবে শুধু মাত্র এইটির কাজ শুরু হতে দেরী আছে।
- তবে বাকি ৫টি লাইন ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মান কাজ শেষ করার লক্ষ্যে নিয়ে কাজ করছে সরকার। তারই মধ্যে প্রথম উড়াল মেট্রোরেল MRT Line-6 এর কাজ উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে বানিজ্যিক যাত্রা বেশ আগেই শুরু হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেলটি হল- MRT Line-1।
- এই এলাকাটি নারায়নগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ গ্রাম আর এই খানে শীতলক্ষ্যা নদীর একেবারে পুল ঘেষে তৈরী করা হচ্ছে MRT Line-1 এর ডিপো। ডিপো তৈরী করাই হচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর আগে যখন MRT Line-6 নির্মান কাজ শুরু করা হয় তখন উত্তরা দিয়া বাড়িতে ডিপোর উন্নয়নের কাজ সর্বপ্রথম শুরু করা হয়।
- রাজধানী ঘিরে ৪টি নদী তার মধ্যে একটি নদী হলো শীতলক্ষ্যা নদী যা বানিজ্যিক ভাবেও খুব ভালো গুরুত্ব রাখে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পূর্বাচল নতুন শহর পর্যন্ত এই এলাকাটি মোট ৭০০ একর আয়তনের। এই জায়গাগুলোর বেশিরভাগ অংশই নিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি। এছাড়াও যে বাকি ব্যক্তিমালিকানা অংশ গুলো ছিল সেই অংশ গুলোও DMTCL কতৃপর্ক্ষ কিনে নিয়েছে। সেই জায়গাতেই চলছে ডিপো উন্নয়নের কাজ।
- মেট্রোরেলের সকল প্রকার যন্ত্রপাতি যার বহন সহ সকল উপকরন রাখা হয় এই ডিপোতে। মেট্রোরেলের জন্য মালামাল আসবে জাপান থেকে সমুদ্র পথ হয়ে এরপর মালামালগুলো মংলা বন্দর থেকে নদী পথে আসবে ডিপোতে। এই জন্য ডিপোকে শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে বসানো হয়েছে অস্থায়ী হিসেবে।
- সামনে জুন থেকে MRT Line-1 এর মূল অবকাঠামোর কাজ শুরু করতে যাচ্ছে DMTCL। MRT Line-1 এর কাজ শুরু করার আগেই ডিপোকে খুব ভাল ভাবে তৈরী করতে হবে। মূল কাজের জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে তার সব গুলোই আসবে বিদেশ থেকে।
পাতাল রেলের রুট ম্যাপ
- MRT Line-1 এর রুট ২টি হবে একটি পাতালে ও আরেকটি হবে উড়ালে। একসাথে দুইটির কাজই শুরু করা হবে।
- পাতালর অংশটি হবে বিমান বন্দর রোডে। এটি বিমান বন্দর রোড হতে শুরু করে মাটির নিচ দিয়ে টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, নদ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতির ঝিল পূর্ব, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ,কমলাপুর এ এসে শেষ হবে।
- ১৯.৮৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য হবে এই রুটের। ২ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড পর পর ট্রেন চলবে এই রুটে। সর্বমোট ১২টি স্টেশন থাকবে কিন্তু সবগুলো স্টেশনই থাকবে মাটির নিচে। পাতালে মেট্রোরেল চলবে ৯০ কিলোমিটার ঘন্টা বেগে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে ২৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় লাগবে।
- অন্য একটি রুট হবে পূর্বাচল অংশে। রাজধানীর স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে ওঠছে পূর্বাচল। ৩০০ ফিট শহর পুরোপুরি প্রস্তত হয়ে গেছে।
- এই খানে সর্বমোট ৯টি স্টেশন থাকবে। বিমানবন্দর থেকে অথবা কমলাপুর থেকে পাতাল রেল এ এসে নতুন বাজার অথবা নর্দা থেকে রুট চেঞ্জ করে পূর্বাচল রুটে আসা যাবে। নর্দা ও নতুন বাজার স্টেশন থাকবে পাতালে এবং এই দুইটা স্টেশন যাত্রীদের রুট পরিবর্তনের জন্য একটি ইন্টারচেঞ্জ হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
পাতাল রেল এর কোচ
- বর্তমানে রাজধানীতে যে উড়ালে যে মেট্রোরেল চলছে সেখানে প্রতিটি ট্রেনে রয়েছে মোট ৬টি কোচ। যার মধ্যে সামনে ও পিছনে ২টি ইঞ্জিন কোচ আছে। কিন্তু পাতালে MRT Line-1 এ যে ট্রেনগুলো চলবে সেখানে মোট ৮টি করে কোচ থাকবে এবং মোট ট্রেনের সংখ্যা হবে ২৫ সেট। আস্তে আস্তে এইটাকে ৩৬ সেট করার পরিকল্পনা সরকারের।
- প্রতিটি পাতাল রেলে সর্বোচ্চ ৩০৮৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম।
পাতাল রেলের অর্থায়ন এবং সরকারের ভূমিকা
- MRT Line-6 জাপানের হাত ধরে বাস্তবায়ন হয়েছে তেমনি MRT Line-1 এর কাজও জাপানই করছে। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৫২,৫৬১,৪৩ কোটি টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো অপারেশন এজেন্সি জাইকা প্রকল্প সহায়তা দিচ্ছে ৩৯,৪৫০,৩২ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১৩,১১১,১১ কোটি টাকা।
- ২০২৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারি ডিপো উন্নয়ন কাজের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় MRT Line-1 এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা। তবে বিশ্বমন্দার এই সময়ে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কতটা আর্থিক ঝুঁকি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা ছিল। তাছাড়া সরকার পূর্নরায় ক্ষমতায় থাকবে কিনা তার জন্য নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল।
- সব কিছুর সংশয় কাটিয়ে এই প্রকল্পে জাপান অর্থায়নে কথা রেখেছে। যার ফলে জুনে মাটির নিচ দিয়ে মেট্রোরেলের মূল কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
- সরকারের প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এর মধ্যে MRT Line-1 চালু করা । তবে নানা সমস্যার কারনে এরি মধ্যে ১ বছর পিছিয়ে গেছে। তবে আশা করা যায় যে ২০২৭ সালের মধ্যে পাটাল মেট্রোরেল এ চড়তে পারবে রাজধানীবাসী।
- প্রতিদিন প্রায় ৮ লক্ষ যাত্রী যাতাযাত করতে পারবে MRT Line-1 এ। যার ফলে রাজধানীর ব্যস্ত সড়কের উপর অনেক চাপ কমবে। জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানীর ব্যবহার কম হবে। প্রতিদিন ঢাকায় মহানগরবাসীর লক্ষ লক্ষ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। MRT Line-1 চালু হলে এই সব কর্মঘন্টা সাশ্রয় হবে।
একনজরে পাতাল রেল তৈরির পরিকল্পনা
- ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে নতুন বাজার এবং কমলাপুরে খননের মাধ্যমে মূল কাজ শুরু হবে। তিন জায়গায় একি সাথে খননের মাধ্যমে কাজ গুলো মাটির নিচে চলতে থাকবে। অর্থাৎ ভিতরে কি হচ্ছে বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায় থাকবেনা।
- বিমানবন্দর মূল সড়ক বরাবর মাটির ১০ মিটার নিচে দিয়ে তৈরি হবে দেশের প্রথম পাতাল রেল। আর রামপুরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এলাকায় সড়কের প্রশস্ততা কম থাকায়, উপর নিচ পদ্ধতিতে মাতির উপরি ভাগ থেকে কমবেশি ৩০ মিটার গভীরতায় টানেল নির্মান করা হবে। অর্থাৎ মাটির নিচেও দুইতলা হবে পাতাল রেলের লাইন। একটি পথ যাওয়ার এবং অন্য পথ যাওয়ার।
- পাতাল রেলের ক্ষেত্রে কর্ণফূলি টানেলের মত করেই কাজ হবে। টানেল বরিং মেশিন টিবিএম মাটির তলে খুড়তে খুড়তে যাবে। পাশাপাশি স্টেশন ও রেললাইন অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরনগুলো একই সঙ্গে বসাতা থাকবে।
- উম্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে প্রতিটি পাতাল রেল স্টেশন নির্মান কালে উত্তোলনকৃত মাটির পরিমাণ হবে, গড়ে প্রায় দুই লক্ষ সাতাশ হাজার ঘনমিটার। এবং প্রতি কিলোমিটার টানেল নির্মানকালে উত্তোলনকৃত মাটির পরিমাণ হবে, গড়ে প্রায় ছিচল্লিশ হাজার ঘনমিটার।
- এই বিপুল পরিমাণ মাটি প্রথমে সরকারি মহাসড়ক, সড়ক ইত্যাদি নির্মানে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া অন্যান্য MRT লাইনসমূহের ডিপোর ভূমি উন্নয়নেও এই মাটি ব্যবহার করা হবে।
উপসংহার
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পাতাল রেল চালু হয়ে গেলে ঢাকা মহানগরের জীবনযাত্রার ভিন্ন এক মাত্রা ও গতি যোগ হবে। মানুষের জীবনে নেমে আসবে পরিবহনের প্রশান্তি। আমাদের এই রাজধানী সমগ্রবিশ্বে মাথা তুলে গৌরবের সাথে দাঁড়িয়ে থাকুক এটাই আমরা সকলে কামনা করি। "প্রথম পাতাল রেল এর যুগে বাংলাদেশঃ বিস্তারিত আলোচনা" পোষ্ট সম্পর্কিত কোন মন্তব্য থাকলে নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুণ।
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url