ওয়ানগালা কাদের উৎসব- এই উৎসবের প্রচলিত কাহিনী

ওয়ানগালা হলো মূলত একটি ধর্মীয় উৎসব। গারো নৃ-গোষ্ঠীরা এই ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্য ও বাংলাদেশের বৃহত্তম ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো জাতির প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো এই ওয়ানগালা। ওয়ানগালা কাদের উৎসব- এই উৎসবের প্রচলিত কাহিনী, এই পোষ্টে আমরা জানবো যে গারোদের ধর্মীয় উৎসব ওয়ানগালা সম্পর্কে।
ওয়ানগালা কাদের উৎসব- এই উৎসবের প্রচলিত কাহিনী
চলুন জেনে নেওয়া যাক ওয়ানগালা উৎসব এবং এর প্রচলিত কাহিনী। 

ভূমিকা

গারো জনগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো ওয়ানগালা উৎসব যা অতি সম্মানের সহিত পালন করে। প্রতি বছরেই অনেক জমকালো উৎসবের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের এই উৎসব পালন করে থাকে। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে গারো নৃ-গোষ্ঠীরা পাহাড়ে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে। 

এই উৎসবটি সাধারণত কৃষিভিত্তিক সামাজিক উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। ফসল উঠানোর এই মহা উৎসবে সূর্যদেবতা ও দেবী মিসি এবং সালজং এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। গারো বা মান্দি ভাষায় ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সামগ্রী। আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ কোনো কিছু উৎসর্গ করা । 

তবে বর্তমানে গারোদের সাংসারেক ধর্মচর্চা প্রায় বিলপ্ত মতোই অবস্থা। গারোরা বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী অনুসারী হয়ে যাচ্ছে। তবে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী আদি উৎসবটির প্রথা এখনও ধরে রেখেছে। যেহেতু ওয়ানগালা নবান্ন উৎসব। 

তাই তারা এই উৎসব হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহন করেন না। তবে বর্তমানে তারা ওয়ানগালা উৎসবটি পালন করে থাকে যিশুখ্রিস্টের উদ্দেশ্যে শস্য উৎসর্গ করে।

ওয়ানগালা কাদের উৎসব

এ দেশে বাঙালি ছাড়াও বসবাস করে অনেক প্রকার জাতি। এই জাতিগুলো আদিবাসী নামেই বেশি পরিচিত। সেই জাতিগুলোর মধ্যে গারো একটি জাতি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা; সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার; গাজীপুরের শ্রীপুরে তারা সাধারণত বসবাস করে। 

‘মান্দি’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে গারো আদিবাসীরা। গারোদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো ‘ওয়ানগালা’। গারো জনগোষ্ঠী মূলত খাদ্যশস্যের বীজ দানকারী দেবতা মিসি সালজংয়ের সম্মানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হয়। 

গারো জাতিরা বিশ্বাস করে যে, সৃষ্টিকর্তা সকল উদ্ভিদ ও শস্যাদির জীবনের ভার সূর্য দেবতা সালজংকে দিয়ে রেখেছেন। সালজং দেবতার দয়া করুণার ওপর নির্ভর করে ফসলের ফলন যেনো ভালো হয়। তাই তার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য গারো নৃ-গোষ্ঠীরা উৎসব হিসেবে ওয়ানগালা পালন করে।

সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল ঘরে তোলার পর এ ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের আগে এই নতুন খাদ্যশস্য সম্পর্নরূপে খাওয়া নিষেধ। গারোদের ভাষা অনুযায়ী ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী ও ‘গালা’ শব্দের অর্থ হলো উৎসর্গ করা। 

গারোরা বিশ্বাস করে যে, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ও তার পরিপক্বতা ঘটানো হয়। তাই উৎপাদিত ফসল গ্রহণের আগে তারা তাদের দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করায় হলো এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। গারোদের গ্রাম প্রধানকে নকমা বলা হয়। নকমা সভা ডেকে এই ওয়ানগালা উৎসব পালনের দিন ঠিক করে। 

ধূপ উৎসর্গ করে ধান পাকার পর জমিতে কিছু পরিমান ধান কাটা হয়। প্রথম দিনে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের জাত, নতুন শাকসবজি, নতুন ফলমূল ও পশু পাখি। নকমা ঝরনা বা খাল থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে নিয়ে আসেন। দুপুরের আগে একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে খেতে যান। আ’সিরকা স্থানে সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে সেটি উৎসর্গ করে পূজা করেন। 

পূজা শেষ করে দুপুরের পরই নকমার বাড়িতে শুরু হয় ওয়ানগালার সেই প্রথম আনুষ্ঠানিকতা। এভাবে টানা তিন দিন নানা প্রকার আচারের মাধ্যমে গারো নৃ-গোষ্ঠিরা তারা তাদের ওয়ানগালা উৎসব পালন করে।

ওয়ানগালা উৎসব কোন ঋতুতে পালন করা হয়

এই উৎসব মূলত সূর্যদেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়ে থাকে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্য ও বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো জাতির প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো ওয়ানগালা। এটি ওয়ান্ন নামেও অনেক পরিচিত। সাধারণত প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে গারো নৃ-গোষ্ঠিরা পাহাড়ে এই উৎসব পালন করে থাকে।

গারোদের প্রধান পেশা

গারোদের প্রধান পেশাই হলো কৃষি কাজ। কৃষি কাজ করে গারোরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যারা গভীর পার্বত্য এলাকায় বসবাস করে তাদের প্রধান বা মূল পেশা হলো জুম চাষ, তবে যারা সমভূমিতে বসবাস করে তারা সমভূমির অন্যান্য অধিবাসীদের মতোই হালচাষ করে থাকে। গারোদের প্রাচীন চাষ হলো জুম চাষ পদ্ধতি।

ওয়ানগালা উৎসবের প্রচলিত কাহিনী

ওয়ানগালা উৎসব সম্পর্কে অনেক প্রচলিত কাহিনী রয়েছে। একটি কাহিনীর ভাবার্থ এমন যে, আদিকালের কথা অনুযায়ী তখনকার মানুষ কচু, গাছের ফলমূল, বনের আলু, লতাপাতা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করত। ভুট্টা, ধান ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোন প্রকার ধারনা ছিলনা। তখন সূর্যদেবতা ছিলেন ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের একচেটিয়া রাজত্ব।

কোন একদিন এক পথে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঠিক তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এ পৃথিবীর এক লোক। ময়লাযুক্ত ছিল সেই লোকটির শরীর ও পোশাক। পিছনে সূর্যদেবতার মতো সুপুরুষকে পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখতে পেয়ে তিনি অত্যান্ত লজ্জা পায় এবং এক পাথরের আড়ালে লুকিয়ে যায়। 

ঘটনাটি খেয়াল করলেন দেবতা এবং লোকটির কাছে নাম জানতে চাইলেন সূর্যদেবতা। লজ্জায় ও ভয়ে জড়সড় হয়ে লোকটি তার নাম জানালেন। নামের সাথে মিল থাকার কারনে সূর্যদেবতা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। গাছের ছায়ায় একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার সময় তিনি দেখলেন যে তার বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। 

সূর্যদেবতার খুব মায়া হলো এবং তাকে তিনি তার সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি দিয়ে খেতে দিলেন। তারপর ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কি না, তা জানতে চাইলে বন্ধু বলেন যে ধান কি, তা তিনি কোনদিন শুনেননি।

সূর্যদেবতার তার জন্য খুব দয়া হলো। তাই তিনি তার বন্ধুকে বললেন যে, আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাবো। তুমি জুমচাষ করে জুমখেতে ধান চাষ করবে। ধান পাকার পর যখন পাকা ধান ঘরে তুলবা ঠিক ওই সময় আমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবা। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার আত্নীয়স্বজনসহ সকলকে আমি আশীর্বাদ করব। 

বাড়ি ফিরে সূর্যবেদতা তার এক দাস এর মাধ্যমে সেই বন্ধুর কাছে ভালো ধানের বীজ পাঠালেন। ওই দাসটি ছিল খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। সে বীজগুলোকে আগুনে ভেজে নষ্ট করে তার পর দেবতার বন্ধুর কাছে নিয়ে গেল। বন্ধুটি বীজ পেয়ে তা তার জুমখেতে বুনলেন। দখিনা বাতাস হলো বৃষ্টিও হলো তবুও বীজ থেকে কোন চারা গজাল না। 

বন্ধু খুবই হতাশ হলো আর ভাবলো যে সূর্যদেবতা তাকে ঠকিয়েছেন। একদিন সূর্যদেবতার অন্য দাসদের পেয়ে তিনি তাদেরকে বেধে রাখলেন। দাসদের কান্নাকাটির কারণে সূর্যদেবতা আসলেন। বন্ধুর মুখে সব কথা তিনি শুনলেন এবং তিনি বললেন যে ভিষণ অন্যায় করেছে আমার দাস তাকে আমি শাস্তি দিচ্ছি। তুমি বাকি দাসগুলোকে ছেড়ে দাও। আমি আবার তোমাকে সতেজ ভাল ধানের বীজ পাঠাবো।

সূর্যদেবতার অনুরোধে দাসগুলো ছাড়া পেলেন। তিনি তার কথামতো বন্ধুর কাছে নতুন বীজ পাঠালেন। সেই বীজ জুমখেতে বুনলেন এবং বীজ থেকে খুব ভাল ধানগাছ গজিয়ে খুব সুন্দর ভাবে বড় হতে থাকল। অবশেষে ধান পাকার সময় আসল এবং ধানও পাকলো। 

কয়েকদিন পরই ধান কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেক ঘটনা। খেতের কিছু পাকা ধান চুরি করে সূর্যদেবতার কয়েকজন দাস। পরে সূর্যদেবতার কাছে তারা অভিযোগ করে যে, আপনাকে না দিয়েই পাকা ধানগুলো আপনার বন্ধু কেটে খেয়েছেন। আপনাকে তারা অসম্মান করেছে। 

সূর্যদেবতা কথা গুলো শুনে খুব অপমানিত বোধ করলো। পরে সেই বন্ধুর পুত্র ও দাসদের ধরে এনে বন্দী করে রাখলেন। এ সংবাদ শুনে বন্ধুটি সূর্যদেবতার কাছে গেলেন এবং অভিযোগটি শুনার পর বলেন যে, আমি এখনও জুমখেতের ধান কাটিনি। তোমাকে অসম্মান করে নিজে আগে খাইনি। তবে কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে নিয়েছে। 

পরে বন্ধুর কথায় শুনে সূর্যদেবতার মন নরম হয় এবং আবারও তারা বন্ধুত্ব গড়েন। তারপর পাকা ধান ঘরে ওঠে। বন্ধুটি মংরে পর্বতের চেন্দেন শিখরে সূর্যদেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন পানীয় ও ধূপ উৎসর্গ করেন। যার ফলে দেবতা অনেক খুশি হয়ে তাকে আশীর্বাদ করেন যেন এ ব্যক্তি ও তার বংশধরদের ভবিষ্যতেও যেনো ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারে।

এই ভাবে ভালো ফসল উৎপাদন করার মধ্যে দিয়ে ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠলেন। পরে তিনি তার পুত্র কন্যাদের জুমচাষে আগ্রাহ সৃষ্টি করলেন। গারোদের এই বিশ্বাস এর কারনেই নতুন ফসল ঘরে তোলার পর ধূপ জ্বালিয়ে পানাহার করে নৃত্য গীতের মাধ্যে দিয়ে তারা ওয়ানগালা উৎসবটি পালন করে থাকে। 

তবে সময় কাল ভেদে আজ বদলে গেছে আদিবাসীদের উৎসবগুলো। ধর্মের ভেদাভেদের কারনে আজ গারোরা হারিয়ে ফেলেছে ওয়ানগালা উৎসবের সেই আদি রূপটি। তবে সংস্কৃতি ও সাহিত্যে এ উৎসব নিয়ে তাদের বিশ্বাসের কাহিনিগুলো আজও জীবন্ত হয়ে বেঁচে আছে।

গারো জনগোষ্ঠীর ভাষা

গারো ভাষা একটি চীনা তিব্বতি ভাষা। আচিক ভাষা হচ্ছে গারো নৃ-গোষ্ঠীর প্রধান ভাষা। ভারতের মেধালয় অঙ্গরাজ্য গারো পাহাড় এলাকার অধিবাসীদের প্রধান ভাষা। বাংলাদেশেও এই ভাষা প্রচলিত। ভাষাবিদদের মতে, গারোরা যে ভাষায় কথা বলে তা মূলত সিনো-টিবেটান ভাষার অন্তর্গত টিবেটো বার্মান উপ- পরিবারের আসাম-বার্মা শাখার অন্তর্গত বোডো বা বরা ভাষা উপ-গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। কোনো প্রকার লিপি বা অক্ষর নেই গারো গোষ্ঠীদের।

উপসংহার

গারো উপজাতিরা অত্যন্ত পরিশ্রমী হয়ে থাকে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ই ঘরে ও বাইরে কাজ করে থাকে। তারা সুঠাম দেহের অধিকারী হয়ে থাকে। গারোদের এই ওয়ানগালা উৎসব থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা নেয়া দরকার। 

তারা তাদের দেবতাকে খুশি করার জন্য প্রতি বছর এই ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারবো যে গারো নৃ-গোষ্ঠীরা কিভাবে কতটুকু সম্মান এর সহিত ওয়ানগালা উৎসবটি পালন করে থাকে।

ওয়ানগালা কাদের উৎসব- এই উৎসবের প্রচলিত কাহিনী, পোষ্ট সম্পর্কে কোন মন্তব্য থাকলে নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন।

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url