আরব বসন্ত বলতে কি বুঝায়, আরব বসন্ত এর কারণ ও ফলাফল

আরবের বিভিন্ন দেশের গণজাগরণকেই আরব বসন্ত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ২০১০ সালে ১৭ই ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামে এক ফল বিক্রেতার পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে সারা শরীরে আগুন লাগিয়ে জীবন দেওয়ার মাধ্যমে এই আরব বসন্তের সূচনা হয়। এই পোষ্টে মূলল "আরব বসন্ত বলতে কি বুঝায় এবং আরব বসন্তের ফলাফল" সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আরব বসন্ত বলতে মূলত আরবের বিভিন্ন দেশের গণজাগরণকেই বোঝায়।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "আরব বসন্ত বলতে কি বুঝায়, আরব বসন্ত এর কারণ ও ফলাফল" সম্পর্কে। 

ভূমিকা

আরব রাষ্ট্রগুলোর জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংগঠিত হয় যাকে আরব বসন্ত বা আর রবিউল আরাবি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের শেষের দিকে আর এই আরব বসন্তের পরিচিতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো। 

এটি মূলত এক ব্যক্তির জীবন দানের কারনে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে আরব বিশ্বের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল গণজাগরণ। গণবিক্ষোভের শুরু তিউনিসিয়ায় হলে এরপর তা আস্তে আস্তে মিশরে, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। 

পরে এই আরব বিশে^র গনভ্যূথানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কদের পতন ঘটাতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল।

আরব বসন্ত এর কারণ

আরব বসন্ত এর কারণ হল- তিউনেশিয়ায় স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর দুঃশাসনের কারনে সেই দেশে বেকারত্বের হার ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই আরব বসন্ত এর সূচনা হয় তিউনেশিয়া থেকেই। স্বৈরাচারী শাসক বেল আলীর দুঃশাসনের প্রতিবাদে এক ফল বিক্রেতা প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্নহুতি দেয়। 

যার কারণে বেন আলীকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য সবাই রাস্তায় নেমে যায়। তখন থেকে আরব বসন্ত এর শুরু। যদিও তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তকে জেসমিন বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর মধ্যে দিয়ে তিউনিসিয়া এবং মিশরের গনপ্রতিবাদের কারনে স্বৈরাচারী শাসকদের পতন হতে শুরু করে। 
মূলত আরব বসন্ত এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার সীমা লংঘন, বেকারত্ব এবং বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং প্রচুর খরার প্রকোপ। 

আরব বিশ্বের খারাপ রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য, দুর্বল অর্থনীতি, শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এই সকল কারনে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

আরব বসন্ত বলতে কি বুঝায়

আরব বসন্ত বলতে মূলত আরবের বিভিন্ন দেশের গণজাগরণকেই বোঝায়। এটি সাধারণত আরব রাষ্ট্রগুলোর জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংগঠিত হয় যা আরব বসন্ত বা আর রবিউল আরাবি নামে পরিচিত লাভ করে। আরব বসন্তের জাগরণ শুরু হয় ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায়।

এই জাগরণের ধাক্কায় অধিকাংশ আবর দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার ব্যাপক পরিববর্তনের প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত লাভ করে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের ফুল ঠিকই ফুটেছে পূর্ণ বিকশিত রূপে। এই দিনে এক ফল বিক্রেতা পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যহারের প্রতিবাদে শরীরে আগুন দিয়ে আত্নহুতি দেয়। 

সেই থেকেই শুরু হয় ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ। প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় তিউনিসিয়ায়। এর পরে আস্তে আস্তে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন আরব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই গণবিক্ষোভে দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষের জীবন হানি হয় বলে দাবি করা হয়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আক্রমন করে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কদের পটন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই আরব বসন্তের গণবিক্ষোভের ফলে তিউনেশিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর পতন ঘটে। পরে ক্ষমতায় আসে ইসলামিক দল ইনাহদাহ। 

একই বছরেই ১১ ফেব্রুয়ারিতে মিশরের ৩০ বছরের শাসক হোসনি মুবারকের পতন ঘটে। পরে সেই বছরে ২০ অক্টোবরে লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি নিহত হয় এবং সাথে সাথে ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

আরব বসন্ত এর ইতিহাস

২০১০ সাল থেকেই আরব বসন্ত এর ইতিহাস এর সূচনা ঘটে। পশ্চিমা সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড়কে আরব বসন্ত হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। সর্বপ্রথম এই গণবিক্ষোভের সূচনা মিশরে, তারপর লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন সহ বিভিন্ন দেশে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের শাসন শেষ হয়। 

তারপরে লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি শাসনেরও অবসান ঘটে। আরবের এই বিক্ষোভের গণঅভ্যূথানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত করে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটায়। 

আরব বসন্ত এর কারণে মাত্র দুই বছওে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন সহ ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের কারনে মোট দেশজ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। 

এই আরব বসন্তের কারনে আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহের সস্মুখিন হয়েছিল এবং এর সাথে সাথে ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সুদান, সিরিয়াতে ছোট আকারের বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এই সকল বিদ্রোহের কারনে হরতাল, বিক্ষোভ, জনসভা সহ র‌্যালি নানা প্রকার কর্মসূচী সংগঠিত হয়েছিল।

তিউনিশিয়ায় গণবিক্ষোভ

তিউনিশিয়ার গণবিক্ষোভে গোটা বিশ্বের তোলপাড় ওঠে গিয়েছিল। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বর্ধিত কর জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়াই তিউনিশার জনগণ মাঠে নেমে ছিল। মূলত তিউনিসিয়া থেকেই আরব বসন্তের সূচনা ঘটে। তিউনিশিয়ার এক যুবক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজ শরীরে আগুন দিয়ে প্রাণ দিয়েছিল। 

যার ফলে পুরো তিউনিশিয়ায় বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোবের এক পর্যায়ে এসে ২০১১ সালের শুরুর দিকে আফ্রিকার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি তিউনিশিয়ার গণঅভ্যূথানে ২৪ বছরের রাজত্বের জাইল- এল আবদিন বেন আলীর শাসন আমল শেষ হয়। পরে বেন আলীর পতনের পর নয়টি সরকার তিউনিসিয়ায় ক্ষমতায় এসেছে।

জেসমিন বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার সময়কাল

তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বেন আলির পতনের জন্য জেসমিন বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। এটি মূলত ছিল একটি গণ-অভ্যুথান যা ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে ২০১২ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিউনিসিয়ায় সংঘটিত হয়েছিল। 

এটি মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক অসন্তোষ ইত্যাদির কারনে এই আন্দোলনটি হয়েছিল। অবশেষে এই আন্দোলনটি তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বেন আলির পতনের দিকে পরিচালিত করেছিল।

মিশরের গণবিক্ষোভ

মিশরের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হোসনি মোবারক। মিশরে আরব বিশ্বে সর্বপ্রথম গণবিক্ষোভের শুরু হয়েছিল। মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের প্রায় ৩০ বছরের শাসনকাল শেষ হয়েছিল। ২০১০ সালের শুরু দিকে প্রথম গণবিক্ষোভই ছিল মিশরীয় সাধারণ মানুষের বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। 

টানা ১৭ দিন গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১১ই ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারকের শাসন আমল শেষ করতে সক্ষম হয় মিশরীয় সাধারণ জনগন। ঠিক ঐ দিনেই মিশরের সব মানুষ স্বৈরাচারি রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের শাসন শেষ করার উদ্দেশ্যর দাবিতে গণবিক্ষোভে নেমে পড়েন। 

১৯৮১ সালে হোসনি মোবারক ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিশরে নিয়োযিত সেনা সদদ্যের সমার্থনে একনায়কতন্ত্রে সূচনা হয়েছিল। পরে মিশরীয় সেনা সদস্যরা হোসনি মোবারকের পতনের পর জনগণের পক্ষালম্ববন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে অতি দ্রুত পট পরিবর্তণ হতে থাকে।

লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি গাদ্দাফি বিরোধী বিদ্রোহ ও লড়াই শুর হয়। লিবিয়ায় এই বিদ্রোহ চলে প্রায় ৯ মাস ধরে। দেশের বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় ২০১১ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারিতে। বিক্ষোভের ফলে বেনগাজিতে একটি থানার কাছে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। 

‘দ্য ডে অব রিভোল্ট’ বলা হয় এই দিনটিকে। বিদ্রোহীরা ২০ ফেব্রুয়ারিতে বেনগাজি শহর দখল করে ফেলে। ১০শে মার্চ গাদ্দাফি বাহিনী ব্রেগা শহরে বোমা বর্ষণ শুরু করে। যার ফলে বিদ্রোহীদের কাছ থেকে জায়িয়াহ ও বিন জাওয়াদ শহর পূনরায় নিজেদের দখলে নিয়ে আসেন। কিন্তু ঠিক ২০ অক্টোবর সিরত শহরে লউাইয়ে নিহত হয় গাদ্দাফি।

আরব বসন্তের ফলাফল

  • আরব বসন্তের ফলে মিশরের রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবাকের ৩০ বছরের স্বৈরাশাসনের পতন ঘটায়। পতন ঘটানোর জন্য কমপক্ষে ১৭০০ মিশরীয়কে প্রাণ দিতে হয়েছি।
  • আরব বসন্তের জোয়ার সরাসরি আছড়ে পড়েছিল মধ্যপ্রচ্যের ছয়টি দেশ তিউনেশিয়া, মিশর, ইয়েমেন, বাহারাইন, লিবিয়া ও সিরিয়া। সেই সাথে শেষ হয়েছিল দীর্ঘ দিনের ক্ষমতাশালী শাসকদের।
  • এই আরব বসন্তের কারনে প্রায় দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
  • স্বৈরাচারী তিউনেশিয়ার শাসক বেন আলীর পতনের পর ক্ষমতায় আসে ইসলামিক দল ‘ইনাহদাহ’। এই আন্দোলনে তিউনিশিয়ায় প্রায় ৩৩৮ জন প্রাণ হারায়।
  • আরব বসন্তের কারনে লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফি দীর্ঘ ৪২ বছরের সামরিক শাসনের ইতি ঘটে। এই আন্দোলনে কারনে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার সাধারণ মানুষ নিহত হন।
  • ২০১২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনে দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহকে পতন করতে সক্ষম হয়। আলী আবদুল্লাহ সালেহ প্রায় ৩৪ বছর শাসন করেছিল। এই আন্দোলনের ফলে প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

উপসংহার

"আরব বসন্ত বলতে কি বুঝায়, আরব বসন্ত এর কারণ ও ফলাফল" পোস্ট সম্পর্কিত কোন মন্তব্য এর জন্য নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। 

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url