ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, ঈদের নামাজের ফজিলত

ঈদের নামাজ মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উপাসনা, যা মূলত ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা নামে পরিচিত। "ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, ঈদের নামাজের ফজিলত" পোষ্টে মূলত এই দুই ঈদের নামায সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, ঈদের নামাজের ফজিলত
চলুন যেনে নেওয়া যাক "ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, ঈদের নামাজের ফজিলত" সম্পর্কে বিস্তারিত।

ভূমিকা

ঈদের নামাজ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ ধর্মীয় উপাসনা। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা—এই দুটি ঈদ উপলক্ষে মুসলমানরা ঈদের নামাজ আদায় করেন। এই নামাজ সাধারণত খোলা মাঠে বা বৃহৎ মসজিদ বা সুবিধাজনক স্থানে জামাতে আদায় করা হয় এবং এটি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সংহতি এবং আনন্দ উদযাপনের প্রতীক।

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পার্থক্য

  • ঈদুল ফিতর: রমজান মাসের দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর, শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।
  • ঈদুল আযহা: যিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা পালিত হয়, যা কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। এটি হজের অন্যতম অংশ এবং ইব্রাহিম (আ.) এর কুরবানির স্মৃতিচারণে উদযাপিত হয়।

ঈদের নামাজ

ঈদের নামাজ মুসলিমদের জন্য একটি বিশেষ উপাসনা, যা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উপলক্ষে আদায় করা হয়। এটি জামাতে আদায় করা নামাজ যা বিশেষভাবে ঈদের দিনের আনন্দ উদযাপন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। ঈদের নামাজ সাধারণত খোলা মাঠে (ঈদগাহ) বা বড় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়।

ঈদের নামাজ কি ওয়াজিব

হ্যাঁ, ঈদের নামাজ ওয়াজিব। ইসলামী শরীয়তে "ওয়াজিব" এমন একটি স্তরের উপাসনা বা কাজ যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা পালন করা বাধ্যতামূলক, তবে ফরজ নয়। ফরজ এবং ওয়াজিবের মধ্যে পার্থক্য হলো, ফরজ হলো এমন কাজ যা সম্পূর্ণভাবে পালন করা আবশ্যক এবং না করলে পাপ হয়, আর ওয়াজিব হলো এমন কাজ যা পালন করা প্রয়োজন, তবে তা না করলে শাস্তির সম্ভাবনা থাকে।

মালিকি মাজহাব (ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) (৭১১-৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ)) এবং শাফি মাজহাব (ইমাম আশ-শাফি (রহ.) (৭৬৭-৮২০ খ্রিস্টাব্দ)) ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা এর নাময কে বলা হয়েছে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। অর্থা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। 

হাম্বালি মাজহাব (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ)) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এর নামায কে ফরজে কেফায়া বলা হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটি উপাসনা যা মুসলমানদের একটি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আদায় করা হলে অন্যান্যদের উপর থেকে সেই দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যায়। তবে, যদি কেউ এটি আদায় না করে, তাহলে সমস্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গুনাহগার হবে।

কিন্তু হানাফি মাজহাব (ইমাম আবু হানিফা (রহ.) (৭০০-৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ)) ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা এর নামাযকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই মতে ঈদের সালাত আদায় করা হচ্ছে ওয়াজিব। অর্থাৎ যা প্রয়োজনীয় বা আবশ্যক হিসেবে গণ্য হয়।

সাইফুল ইসলাম ইমাম তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ), ইমাম শাওকানি (১১২৫-১২০৯ খ্রিস্টাব্দ) সহ আরও অনেকেই হানাফি মাজহাব এর মতামতকে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ওয়াজিব। তাই এই বিষয়ে কেউ সন্দেহ পোষন করলে তাঁর গুনাহ হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

কোরআন শরিফের সূরাহ আল কাউসার এ আল্লাহ তা আলা বলছেন-
উচ্চারন- ফাসাল্লি লি রাব্বিকা ওয়ান হার।
অর্থ- অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কোরবানী করুন।

এখানে ঈদুল আযহার প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা) কে বলা হচ্ছে, আপনি আগে সালাত আদায় করুণ আপনার রবের জন্য, তারপর আপনি কুরবানি দিন। তাহলে এখানে কিন্তু আদেশ দেওয়া হয়েছে সালাত পড়ার জন্য।

সহিহ বুখারিতে একটি হাদিস আমরা পাই-

উম্মে আত্বিয়্যা (রা.) বলেন, "নবী (সা.) আদেশ করেছেন যে, আমরা (নারীরা) ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করবো, এমনকি হায়েজা মহিলারাও। তারা নামাজের স্থানে থাকবেন না, কিন্তু মুসলিমদের দোয়া এবং খুতবা শুনবেন।"

তাই উপরিউক্ত আলোচনরা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কোরনআন এবং হাদিসে ঈদের নামাজ আদায় করাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাই মুসলমানদের জন্য এটি পালন করা ওয়াজিব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যদিও তা ফরজ নয়। এটি ইসলামী ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম

ঈদের নামাজ পড়া হয় ঈদের দিনে, যা ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা নামে পরিচিত। ঈদের নামাজ অবশ্যই জামাতের সাথে পড়তে হবে। নামায সাধারণত উম্মুক্ত জায়গা, মসজিদ কিংবা পরিষ্কার কোন জায়গায় জামাত এর সাথে আদায় করতে হবে।

ঈদের নামায দুই রাতাক এবং ছয়টি অতিরিক্ত তাকবির সহ আদায় করতে হয়। এই নামাযে কোন আজান এবং ইকামত এর প্রয়োজন নেই। উচ্চ স্বরে কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সালাত আদায় করতে হয়। নামায আদায়ের পর খুতবা পড়া হয়।

ঈদের নামাযের নিয়ত

উচ্চারনঃ নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাইন সালাতি ঈদিল ফিতর (ঈদুল আযহা), মায়া ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তা’আলা ইকতাদাইতু বিহাযাল ইমাম, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।

বাংলা অর্থঃ আমি ঈদুল ফিতরের (ঈদুল আযহার) দুই রাক’আত ওয়াজিব নামাজ অতিরিক্ত ৬ তাকবিরের সঙ্গে এই ইমামের পেছনে কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর জন্য আদায় করছি – আল্লাহু আকবার।

প্রথম রাকাত

  • নামাযের নিয়ত করে "আল্লাহু আকবার" বলে হাত বাঁধতে হবে।
  • সানা পড়তে হবে।
  • সানা- সুবহানাকাল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা, ওয়াতা আলা যাদ্দুকা, ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
  • এরপর "আল্লাহু আকবার" বলে অতিরিক্ত তিন তাকবির দিয়ে সুরা ফাতিহা এবং অন্য সুরা পাঠা করা। ১ম এবং ২য় তাকবির দেওয়ার পর হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে এবং ৩য় তাকবিরে হাত বেধে নিতে হবে।
  • এরপর রুকু ও সিজদা দেওয়ার মাধ্যমে ১ম রাকাত সম্পন্ন করা।

দ্বিতীয় রাকাত

  • সুরা ফাতেহা এবং অন্য সুরা পাঠ করা।
  • এরপর "আল্লাহু আকবার" বলে অতিরিক্ত তিন তাকবির দিতে হবে। প্রতি তাকবিরেই হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে।
  • এরপর রুকুর তাকবির দিয়ে রুকুতে যেতে হবে এবং সিজদা আদায় করে তাশাহুদ, দুরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে ২য় রাকাত সম্পন্ন করতে হবে।

ঈদের নামাজ না পড়লে কি গুনাহ হবে

হ্যা ঈদের নামাজ আদায় না করলে গুনাহ হবে। ঈদের নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং মুসলিম সমাজের একটি মুখ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান। নামাজ না পড়া মুসলিম ধর্মে একটি বড় গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। 

যেহেতে ঈদের নামায ওয়াজিব এবং একজন মুসলিমের যদি ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ থাকে এবং নামাজ না পড়ে, তবে তার এই অবস্থার জন্য ওয়াজিব নামায আদায় না করার গোনাহ এর শামিল হবে।

ঈদের নামাজ না পেলে করণীয় কী

হানাফী মাযহাবে, যদি কোনও মুসলিম ঈদের জামাত না পায় অথবা কোনও কারণে জামাতে যোগ দিতে না পারেন, তবে তারা তবে তারা নিজের বাসা বা অন্য সুবিধাজনক স্থানে আবার দু’ রাক‘আত একা অথবা দুই তিনজন জামাতে আদায় করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে খুতবার দরকার নেই। জামাতে যদি এক রাকাত কম পায় তাহলে বাকী এক রাকাত নিজে আদায় করে নিবে।

মহিলারা কি ঈদের নামাজ ঘরে পড়তে পারবে

আমরা সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিম হাদিসে পাই-

হযরত উম্মে আত্বিয়্যা (রা.) বর্ণনা করেছেন, "রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে (মহিলাদের) ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে নিয়ে যেতে আদেশ করতেন।"

উম্মে আত্বিয়্যা (রা.) বলেন, "নবী (সা.) আদেশ করেছেন যে, আমরা (নারীরা) ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করবো, এমনকি হায়েজা মহিলারাও। তারা নামাজের স্থানে থাকবেন না, কিন্তু মুসলিমদের দোয়া এবং খুতবা শুনবেন।"

হাদিসের আলোকে বোঝা যায় যে মহিলাদের জন্য ঈদগাহে নামাজ আদায় করাই উত্তম। তবে কোন কারনে ঈদগাহে যেতে না পারলে নিজ বাসাতে আদায় করে নিতে পারবেন। তবে যেহেতু নিজ বাসাতে ঈদের নামায আদায় করার কোন হাদিস খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই ঈদগাহে, মসজিদে বা কোন সুবিধাজন স্থানে জামাতে আদায় করাই উত্তম।

ঈদের নামাজ কয় তাকবীর

ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবিরের সংখ্যা ৬ টি। প্রথম রাকাতে সানা পড়ে ৩ তাকবির এবং ২য় রাকাতে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে ৩ তাকবির।

ঈদের নামাজের ফজিলত

ঈদের নামাজের কিছু ফজিলত নিম্নরূপ:
  • আল্লাহর নির্দেশ পালন: ঈদের নামাজ আদায় করে মুসলিমরা আল্লাহর আদেশ পালন করে। এটি তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
  • ধর্মীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ: ঈদের নামাজ জামাতে আদায় করার মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের মাঝে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এটি তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও সহানুভূতি বাড়ায়।
  • গুনাহ মাফ: ঈদের দিন রোজা রাখা ও ঈদের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে মুসলিমদের অতীত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। ঈদুল ফিতরের রোজার পর এই নামাজ আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বিশেষ মাধ্যম।
  • পুরস্কার লাভ: আল্লাহ ঈদের নামাজ আদায়কারীদের জন্য বিশেষ পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন। ঈদের নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের জন্য রহমত ও বরকত বর্ষণ করেন।
  • সামাজিক একতা: ঈদের নামাজের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষ একত্রিত হয়, যা সমাজের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বোধকে জাগ্রত করে।
  • আত্মশুদ্ধি: ঈদের নামাজ আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম। মুসলিমরা এই নামাজের মাধ্যমে তাদের আত্মাকে পবিত্র ও শুদ্ধ করে তোলে।

মন্তব্য

সর্বোপরি, ঈদের নামাজ মুসলিমদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে এবং তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক উন্নতি ও সমাজিক একতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। "ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, ঈদের নামাজের ফজিলত" পোষ্ট সম্পর্কিত মন্তব্যের জন্য নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন।

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url