কসর নামাজের নিয়ম, কসর নামাজের মাসআলা
কসর নামাজ ভ্রমণের সময় মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ দয়া। এটি ফরজ নামাজকে সংক্ষিপ্ত আকারে আদায়ের সুযোগ দেয়, যাতে দীর্ঘ সফরেও ইবাদত সহজ হয়। এই পোস্টে কসর নামাজের নিয়ম, মাসআলা এবং ভ্রমণকালীন নামাজ আদায়ের সব শর্ত বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "কসর নামাজের নিয়ম, কসর নামাজের মাসআলা" সম্পর্কে বিস্তারিত।
ভূমিকা
কসর নামাজ ইসলামের একটি বিশেষ বিধান, যা ভ্রমণের সময় মুসলিমদের জন্য সহজতর করে দেওয়া হয়েছে। কসর নামাজের মর্ম হলো ফরজ নামাজের সংক্ষিপ্ত আকারে আদায় করা, বিশেষ করে চার রাকাতবিশিষ্ট যোহর, আসর ও এশার নামাজকে দুই রাকাতে সীমাবদ্ধ করা। এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুসলিমদের জন্য একটি সাদাকা বা উপহার।
ইসলামের প্রতিটি বিধানে সহজিকরণ ও মানবিক দিক রয়েছে, এবং কসর নামাজ তার একটি উদাহরণ। ভ্রমণের সময় মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম বিবেচনা করে আল্লাহ তাআলা এই নামাজকে সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি দিয়েছেন, যাতে ফরজ ইবাদত আদায় করা সহজ হয়।
কসরের নামাজের পরিচয়
ইসলামে সফরের সময় নামাজে কিছুটা সহজতা প্রদানের বিধান রয়েছে, যাকে কসর নামাজ বলা হয়। ‘কসর’ শব্দের অর্থ হলো সংক্ষিপ্তকরণ বা কমানো। যখন কেউ শরীয়তের শর্তানুসারে ভ্রমণ করে, তখন তাকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফিরের জন্য ইসলামী শরীয়ত বিশেষ কিছু ছাড় দিয়েছে, যা একজন সাধারণ মুকিমের জন্য প্রযোজ্য নয়।
হানাফী মাজহাব অনুযায়ী, সফরে থাকা মুসাফিরের জন্য নামাজে কসর করা ফরজ। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কসর না করে, তাহলে তাকে গুনাহগার হতে হবে। তবে, যদি কোনো মুসাফির মুকিম (অর্থাৎ স্থানীয়) ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন, সেক্ষেত্রে তাকে ইমামের পুরো নামাজের অনুসরণ করতেই হবে।
এটি মনে রাখা জরুরি যে, কসর করার বিধান কেবল ফরজ নামাজের জন্যই প্রযোজ্য। সুন্নত নামাজে কসর করার কোনো সুযোগ নেই; সুন্নতগুলো স্বাভাবিকভাবেই আদায় করতে হবে।
মুসাফিরের পরিচয়
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, এমন ব্যক্তিকে মুসাফির বলা হয়, যে ৪৮ মাইল বা তিন মনজিল, অর্থাৎ প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দূরত্বে যাওয়ার ইচ্ছা করে এবং সেখানে ১৫ দিনের কম সময় অবস্থানের নিয়ত করে। শহরের বাসিন্দা হলে, শহরের সীমানা ছাড়ানোর পর থেকে এবং গ্রামের বাসিন্দা হলে নিজ ইউনিয়ন বা পৌরসভার সীমানা অতিক্রম করার পর থেকে সে মুসাফির হিসেবে বিবেচিত হবে।
একবার মুসাফির হয়ে গেলে, তখন থেকেই নামাজের কসরসহ অন্যান্য মুসাফিরের বিধান তার ওপর প্রযোজ্য হবে। (সূত্র: শামি: ২/৫৯৯-৬০২, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৯৪-৯৫)
সফরের সময় মুসাফিরদের জন্য জোহর, আসর ও ইশার চার রাকাত ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত করে আদায় করা ফরজ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দুই রাকাত নামাজকেই কসর নামাজ বলা হয়। তবে ফজর, মাগরিব এবং বিতির নামাজে কসর করার বিধান নেই; এগুলো স্বাভাবিকভাবে পড়তে হয়।
মুসাফির কখন মুকিম হবে?
যে সীমানা অতিক্রম করে সে মুসাফির হয়েছিল, সেই সীমানায় পুনরায় প্রবেশ করলেই সে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে। (সূত্র: শামি: ২/৬০৪)
যদি কারো একাধিক আবাসস্থল থাকে, তবে যেকোনো একটিতে প্রবেশ করলেই সে মুকিম হয়ে যাবে। (সূত্র: বাদায়েউস সালায়ে: ১/২৮০)
এছাড়া, নিজের আবাসস্থল ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় অবস্থানের নিয়ত করলে, সেখানেও তাকে মুকিম হিসেবে বিবেচনা করা হবে। (সূত্র: হিন্দিয়া: ১/১৪২)
কসর নামাজের বিধান
ইসলাম শরীয়ত, সফর বা ভ্রমণের সময় নামাজে সহজতা প্রদানের উদ্দেশ্যে কিছু বিশেষ বিধান রেখেছে, যা কসর নামাজ নামে পরিচিত। কসর শব্দের অর্থ হলো "সংক্ষিপ্তকরণ"। সফরে থাকা অবস্থায় মুসাফিরের জন্য কিছু ফরজ নামাজ সংক্ষেপ করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কোনো ব্যক্তি যখন শরীয়তের শর্ত অনুযায়ী মুসাফির হন, অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দূরত্বে ভ্রমণ করেন এবং সেখানে ১৫ দিনের কম থাকার নিয়ত করেন, তখন তিনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন। মুসাফির হওয়ার পর থেকে তার ওপর কসর নামাজের বিধান কার্যকর হবে।
কসর নামাজের বিধান অনুযায়ী, মুসাফির অবস্থায় জোহর, আসর এবং ইশার চার রাকাত ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত করে আদায় করতে হবে। এটি মুসাফিরের জন্য ফরজ, এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কসর না করলে তিনি গুনাহগার হবেন।
কোন কোন নামাজে কসর নেই?
নামাজের মধ্যে কসর করার বিধান সাধারণত সফরের সময় প্রযোজ্য হয়, যখন একজন মুসলিম ৪৮ মাইল বা তার বেশি দূরত্ব ভ্রমণ করেন। তবে, সব নামাজে কসর করা যায় না। কসর নামাজের ক্ষেত্রে কোন কোন নামাজে কসর নেই, তা নিচে সাজিয়ে উল্লেখ করা হলো:
- ফজরের নামাজ: ফজরের নামাজের কোনো কসর নেই। সফরকালেও দুই রাকাতই পড়তে হবে। এটি সব সময় দুই রাকাত ফরজ।
- মাগরিবের নামাজ: মাগরিবের নামাজেও কসর করা হয় না। এই নামাজ তিন রাকাত ফরজ, এবং সফরকালেও তিন রাকাতই পড়তে হবে।
- বিতর নামাজ: বিতর নামাজে কসর নেই। এটি তিন রাকাতের সুন্নত নামাজ, যা সফরকালেও পূর্ণ তিন রাকাতই পড়তে হবে।
কসর নামাজের শর্তাবলী
- শুধু ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে: কসর শুধুমাত্র জোহর, আসর এবং ইশার ফরজ নামাজের জন্য প্রযোজ্য। সুন্নত এবং নফল নামাজে কসর করার কোনো বিধান নেই। তবে মুসাফিরের জন্য সুন্নত নামাজ আদায়ে কষ্ট হলে তা না পড়লেও গুনাহ হবে না।
- মুকিম ইমামের অনুসরণ: যদি কোনো মুসাফির মুকিম (অর্থাৎ স্থানীয়) ইমামের পেছনে নামাজ পড়েন, তাহলে তিনি কসর করতে পারবেন না। তাকে ইমামের মতো পুরো নামাজ আদায় করতে হবে।
কসর নামাজের সুবিধা
আল্লাহ তাআলা বান্দাদের কষ্ট লাঘবের জন্য কসর নামাজের বিধান দিয়েছেন। এটি ইসলামের সহজতা প্রদানের একটি নিদর্শন। তাই সফরকালে মুসাফিরের জন্য কসর নামাজ আদায় করা একটি বিশেষ অনুগ্রহ।
কসর নামাজ কতদিন
কসর নামাজের বিধান তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন কোনো ব্যক্তি ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য ৪৮ মাইল (প্রায় ৮৮ কিলোমিটার) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণের নিয়ত করেন। মুসাফির হিসেবে তিনি এই কসর নামাজ আদায় করতে পারবেন যতদিন পর্যন্ত ওই স্থানে ১৫ দিনের কম থাকার ইচ্ছা থাকে।
তবে ১৫ দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত করলে, তিনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন এবং তখন কসর করার সুযোগ থাকবে না। ১৫ দিনের বিধান ইসলামী শরীয়তের ফিকহ বইগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে হানাফী মাজহাবের ফিকহের গ্রন্থগুলোতে। এর ভিত্তি হাদিস ও ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্তের ওপর।
হানাফী ফিকহে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি ১৫ দিন বা তার চেয়ে বেশি সময় এক স্থানে থাকার নিয়ত করেন, তাহলে তিনি সেই স্থানে মুকিম বলে গণ্য হবেন এবং তার জন্য কসর নামাজের বিধান প্রযোজ্য থাকবে না।
বিভিন্ন ফিকহের গ্রন্থে যেমন "বাদায়েউস সানায়ে," "ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া," এবং "শামি" ইত্যাদিতে ১৫ দিনের এই বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখিত রয়েছে। হানাফী মাজহাবে এই বিধান মুসাফির ও মুকিমের পার্থক্য নির্ধারণের জন্য একটি নির্ধারিত সময়সীমা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
কসর নামাজের দূরত্ব
কসর নামাজের বিধান প্রযোজ্য হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভ্রমণ দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। হানাফী মাজহাবের মতে, একজন ব্যক্তি যদি ৪৮ মাইল বা প্রায় ৮৮ কিলোমিটার (প্রাচীন মাপকাঠি অনুযায়ী, তিন দিনের পদযাত্রা) দূরত্ব ভ্রমণের নিয়ত করেন, তবে তিনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন এবং তার জন্য কসর নামাজ আদায় করা বাধ্যতামূলক হবে।
হাদিসে উল্লেখিত দিকনির্দেশনা
নির্দিষ্ট দূরত্বের বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী দূরত্বে নামাজ কসর করেছেন। হাদিস অনুযায়ী, হিজরী যুগে মুসাফির হওয়ার সাধারণ দূরত্ব ছিল প্রায় ৪৮ মাইল বা তার কাছাকাছি। আবু হানিফা (রহ.) ও অন্যান্য ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা এই দূরত্বকে মুসাফির হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে গণ্য করেছেন।
হানাফী মাজহাবের ফিকহ গ্রন্থগুলোর মধ্যে যেমন "ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া," "শামি," এবং "বাদায়েউস সানায়ে" ইত্যাদিতে এই ৪৮ মাইল বা তিন দিনের পদযাত্রার দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিকহের এই গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই দূরত্ব ভ্রমণের নিয়ত করলেই একজন ব্যক্তি মুসাফির বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য কসর নামাজ পড়া আবশ্যক হবে।
"কসর নামাজের দূরত্ব" হানাফী মাজহাবের মতে ৪৮ মাইল বা প্রায় ৮৮ কিলোমিটার। ফিকহ গ্রন্থে এই দূরত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং হাদিসের আলোকে তা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কসর নামাজের বিধান: কুরআনের আলোকে
- আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নিসা, আয়াত ১০১-এ মুসাফিরদের জন্য কসর নামাজের অনুমতি দিয়েছেন। তিনি বলেন:
"আর যখন তোমরা যমীনে সফর করবে, তখন তোমাদের সালাত সংক্ষিপ্ত (কসর) করতে কোনো দোষ নেই। যদি আশঙ্কা কর যে, কাফিররা তোমাদের ফিতনায় ফেলবে। নিশ্চয়ই কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।"এই আয়াতে সফরের সময় চার রাকাত ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদিও এখানে "যদি তোমাদের ভয় হয়" (إِنْ خِفْتُمْ) বলা হয়েছে, এটি অধিকাংশ অবস্থার প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তখনকার সময়ে পুরো আরবভূমি ছিল যুদ্ধের ময়দান। তাই ভ্রমণ ছিল খুবই বিপজ্জনক।
তবে, ইসলামী শরীয়ত বিশেষজ্ঞদের মতে, কসর নামাজের জন্য শুধুমাত্র ভয় বা বিপদের পরিস্থিতি শর্ত নয়।
অর্থাৎ, মুসাফির হলে বিপদ বা আশঙ্কা ছাড়াও সফরের কারণে কসর নামাজ আদায় করা বৈধ এবং শরীয়তের বিধান অনুযায়ী অনুমোদিত।
- আল্লাহ তাআলা সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৩৮-২৩৯-এ বলেন:
"তোমরা সালাতসমূহ এবং মধ্যবর্তী সালাতের হিফাযত করো এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে। কিন্তু যদি তোমরা ভয় কর, তবে হেঁটে বা আরোহণ করে (আদায় করে নাও)। এরপর যখন নিরাপদ হবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন, যা তোমরা আগে জানতে না।"মধ্যবর্তী সালাত: এখানে "মধ্যবর্তী সালাত" বলতে আসরের নামাজকে বোঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস থেকে এটি নির্দিষ্ট হয়েছে, যেখানে তিনি খন্দকের যুদ্ধে "সালাতে উসত্বা" বা মধ্যবর্তী নামাজকে আসরের নামাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন (বুখারী ২৯৩১; মুসলিম ৬২৭)।আয়াত ২৩৯-এর ব্যাখ্যা: যদি এমন পরিস্থিতি আসে যখন শত্রুর ভয় বা বিপদের কারণে সালাত আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন যেভাবে সম্ভব, সেভাবেই সালাত আদায় করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, হেঁটে হেঁটে অথবা বাহনের ওপর বসে। এরপর, যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা নিরাপদ হয়ে যাবে, তখন আবার স্বাভাবিকভাবে সালাত আদায় করতে হবে, যেমন আল্লাহ তোমাদের শিখিয়েছেন।
কসর নামাজের বিধান: হাদিসের আলোকে
সফরের সময় সালাত সংক্ষিপ্ত (কসর) করার বিধান ইসলামিক শরিয়তে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দিনের সফরকেও সফর হিসেবে গণ্য করেছেন এবং মুসাফিরদের জন্য সালাত কসর করার অনুমতি দিয়েছেন। ইবন উমর ও ইবন আব্বাস (রাঃ) চার বুরদ অর্থাৎ প্রায় ষোল ফরসাখ দূরত্বে (প্রায় ৪৮ মাইল বা ৭৭ কিলোমিটার) যাত্রা করলে তারা সালাত কসর করতেন এবং সাওম পালন করতেন না।
- ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার সফরে উনিশ দিন অবস্থান করেছিলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি কসর নামাজ আদায় করেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) আরও বলেন, আমরা যদি কোনো স্থানে উনিশ দিনের জন্য অবস্থান করি, তাহলে কসর নামাজ পড়ি। কিন্তু উনিশ দিনের বেশি অবস্থান করলে আমরা পূর্ণ নামাজ আদায় করি। (সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বার: ১০১৯; আন্তর্জাতিক নাম্বার: ১০৮০)
এই হাদিসের ভিত্তিতে বুঝা যায় যে, উনিশ দিনের কম সময় কোথাও অবস্থান করলে মুসাফির অবস্থায় কসর নামাজ আদায় করা বৈধ। তবে, উনিশ দিনের বেশি থাকার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা থাকলে তখন কসর না করে পুরোপুরি নামাজ আদায় করতে হবে।
- আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদিনা থেকে মক্কায় গমন করি। সেখানে অবস্থানকালে এবং মদিনায় ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি নিয়মিতভাবে দু’রাকা’আত করে সালাত আদায় করতেন। আমি (রাবী) আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, মক্কায় আপনি কতদিন অবস্থান করেছিলেন? উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সেখানে দশ দিন ছিলাম। (সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ১০২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৮১)।
- আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মদিনায় যুহরের সালাত চার রাকাআত এবং যুল-হুলাইফায় আসরের সালাত দু'রাকাআত আদায় করেছি। (সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ১০২৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৮৯)
- আনাস (রাঃ) আরও বর্ণনা করেছেন যে, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মক্কায় দশ দিন অবস্থান করেছিলাম এবং এই সময় আমরা সালাত কসর করতাম। (সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৯৬৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪২৯৭)
- ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের সময় সফরে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ১৯ দিন অবস্থান করেছিলাম এবং এ সময় আমরা নামায কসর করেছিলাম। ইবনু আব্বাস (রাঃ) আরও বলেছেন, আমরা সফরে ১৯ দিন পর্যন্ত কসর করতাম, কিন্তু এর বেশি দিন অবস্থান করলে পূর্ণ সালাত আদায় করতাম। (সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৯৬৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪২৯৯)
- মুসাফিরদের জন্য কসর সালাত করা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সাদাকা হিসেবে প্রদত্ত। সাহাবী উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বর্ণিত, তিনি যখন এই বিষয়ে অবাক হন এবং বলেন যে, লোকেরা এখন নিরাপদ, কেন কসর করা হচ্ছে? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি একটি সাদাকা। তোমরা তার সাদাকাটি গ্রহণ করো।" (সহীহ মুসলিম)
কসর নামাজের নিয়ম
কসর নামায একটি বিশেষ নিয়ম যা ভ্রমণকালে মুসলমানদের জন্য সহজীকরণ হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি দান, যা সফর অবস্থায় ফরয সালাতের সময় কম রাকাআত পড়ার সুযোগ দেয়। কসর নামাযের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম এবং শর্ত রয়েছে, যেগুলো নিম্নরূপ:
- ভ্রমণের দূরত্ব: ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে ৪৮ মাইল বা তার বেশি দূরত্ব অতিক্রম করলে কসর নামায আদায় করা যাবে।
- ১৫ দিনের কম অবস্থান: যদি সফরের গন্তব্যস্থলে ১৫ দিনের কম থাকার নিয়ত থাকে, তাহলে ব্যক্তি সেখানে পৌঁছে কসর নামায আদায় করবেন।
- ১৫ দিনের বেশি অবস্থান: যদি গন্তব্যস্থলে ১৫ দিনের বেশি থাকার নিয়ত থাকে, তাহলে কসর নামায পড়া হবে না; স্বাভাবিকভাবে চার রাকাআত নামায আদায় করতে হবে।
- কোন নামাযে কসর: কেবল চার রাকাআত বিশিষ্ট ফরয নামায, যেমন যোহর, আসর এবং এশার নামায কসর করে ২ রাকাআত আদায় করা হয়। মাগরিবের ৩ রাকাআত এবং ফজরের ২ রাকাআত স্বাভাবিকভাবেই পড়া হবে। এছাড়া, এশার নামাযের সাথে বিতর পড়তে হবে।
কসর নামাজের বাংলা নিয়ত
নিয়ত হলো অন্তরের ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য, যা মানুষের মনের গভীর থেকে আসে। ইসলামে নামাযের নিয়ত মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই, বরং অন্তরে ইচ্ছার প্রকাশই যথেষ্ট। কসর নামাযের জন্য বিশেষ কোনো ভিন্ন নিয়ত নেই। এটি ফরয নামাযের নিয়তের মতোই, তবে ভ্রমণের কারণে কসর করার বিষয়টি মাথায় রেখে দুই রাকাত আদায়ের কথা অন্তরে রাখতে হবে।
কসর নামাযের নিয়ত করার পদ্ধতি
যেভাবে সাধারণত ফরয নামাযের নিয়ত করা হয়, ঠিক একইভাবে কিবলামুখী হয়ে নিয়ত করতে হবে। তবে এখানে শুধু ভ্রমণের কারণে কসর করা হচ্ছে এবং দুই রাকাত পড়তে হবে – এই ব্যাপারটি মনের মধ্যে পরিষ্কার থাকতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ-
"আমি আল্লাহর জন্য দুই রাকাআত ফরয নামায পড়তে ইচ্ছা করছি, কিবলামুখী হয়ে, বর্তমানে মুসাফির হিসেবে, আল্লাহু আকবার।"
কসর নামাযের ফযিলত
কসর নামাযের বিধানের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে, তা হলো কোনো অবস্থাতেই ফরয ইবাদত থেকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া যায় না, এমনকি সফরকালেও।
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "তোমরা সফরে নামাযকে কসর করো, এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম প্রতিদান।" (বায়হাকি)
- হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কসর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ বলেছিলেন, "এটি একটি সাদক্বাহ, যা আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের জন্য দান করেছেন। তোমরা এটি গ্রহণ করো।" (সহীহ মুসলিম)
- যে ব্যক্তি সফরে চার রাকাআত ফরয নামায পড়ে, সে আল্লাহর দেওয়া সাদক্বাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহর সাদক্বাহ গ্রহণ করা এবং সফরে কসর করা ফরয। (তাবরানী, মুজামে সাগীর)
- হযরত য়ালা ইবনে উমাইয়া (রাঃ) বলেন, তিনি হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, "আল্লাহ বলেছেন, যদি কাফেরদের পক্ষ থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকে, তাহলে কসর নামায পড়তে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তো নিরাপত্তার যুগ, কসর না করাই উচিত।" উত্তরে হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, "আমি নিজেও এ ব্যাপারে অবাক হয়েছিলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, 'এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য একটি ছদকা। তোমরা আল্লাহর এই ছদকা গ্রহণ করো।'" (সহীহ মুসলিম)
কসর নামাজের মাসআলা
কসর নামাজ হলো ইসলামে সফরের সময় সংক্ষিপ্তভাবে ফরজ নামাজ আদায় করার বিধান। এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সাদাকা বা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য সহনীয় করে তুলেছে। কসর নামাজের বিভিন্ন মাসআলা ও বিধি-বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
কসর নামাজের রাকাত সংখ্যা
সফরকালে শুধু চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো (যোহর, আসর, এশা) দুই রাকাতে কসর করে আদায় করা হয়। মাগরিবের নামাজ এবং ফজরের নামাজ পূর্বের নিয়মে আদায় করা হবে।
ভ্রমণের দূরত্ব
সাধারণভাবে, ৪৮ মাইল বা তার বেশি দূরত্ব অতিক্রম করলে কসর নামাজ পড়তে হয়। এ দূরত্বে ভ্রমণ করলে মুসাফির গণ্য হবে এবং সফরের সকল সুবিধা ভোগ করা যাবে।
১৫ দিনের নিয়ম
ভ্রমণের সময় যদি ১৫ দিনের কম থাকার নিয়ত থাকে, তাহলে মুসাফির হিসেবে নামাজ কসর করা হবে। কিন্তু ১৫ দিনের বেশি থাকার নিয়ত থাকলে মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামাজ আদায় করতে হবে।
যদি ভ্রমণের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পাঁচ দিন, দশ দিন বা বার দিন অবস্থান করা হয়, তবে পুরো সফরের সময়জুড়ে কসর নামাজ পড়তে হবে, যতক্ষণ না কোথাও ১৫ দিনের বেশি অবস্থানের পরিকল্পনা করা হয়।
মহিলাদের কসর নামাজের বিধান
বিয়ের পর মহিলার স্থায়ী বাসস্থান (ওয়াতনে আসলী) হবে তার শ্বশুরবাড়ী। যদি তার বাপের বাড়ী ৪৮ মাইল বা তার বেশি দূরত্বে হয় এবং সেখানে সে ভ্রমণ করে, তবে তাকে কসর নামাজ আদায় করতে হবে। তবে শ্বশুরবাড়ীতে যদি সে কিছুদিনের জন্য যায় এবং স্থায়ীভাবে বাপের বাড়ীতে থাকার ইচ্ছা করে, তবে বিয়ের আগের বাসস্থান (বাপের বাড়ী) তার জন্য স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত হবে।
অধীনস্থদের নিয়ম
মহিলারা যদি স্বামীর সাথে, কর্মচারীরা যদি মালিকের সাথে বা পুত্ররা যদি পিতার সাথে সফরে থাকে, তবে তাদের ব্যক্তিগত নিয়ত কোনো প্রভাব ফেলবে না। অর্থাৎ, মূলত স্বামী, মুনিব বা পিতার ইচ্ছা বা নিয়তের উপর নির্ভর করবে তারা কসর করবে কিনা।
মুকীম ও মুসাফিরের ইমামতি
মুসাফির ইমাম হলে, তার মুকীম মুক্তাদিদের জানানো উচিত যে, সে কসর নামাজ আদায় করবে। দু'রাকাত শেষ করার পর মুকীম মুক্তাদিরা তাদের বাকি রাকাতগুলো পূর্ণ করবে।
মুকীম ইমামের পেছনে মুসাফিরের জন্য চার রাকাত নামাজই পড়তে হবে। এ অবস্থায় কসর হবে না।
কসর নামাজের নিয়ম পরিবর্তন
যদি কোনো মুসাফির সফরের মধ্যে ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য থাকার নিয়ত করে, তবে সে কসর নামাজ পড়বে। তবে, যদি পরে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে ১৫ দিনের বেশি সময় থাকবে, তাহলে সে মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামাজ আদায় করবে।
কাযা নামাজের নিয়ম
সফরের মধ্যে কাযা হওয়া নামাজগুলো বাড়ি ফিরে কসর করে আদায় করা যাবে। আবার বাড়িতে থাকা অবস্থায় কাযা হওয়া নামাজগুলো সফরে কসর করে পড়া যাবে না, পূর্ণ রাকাত পড়তে হবে।
কসর নামাজের ফজিলত
কসর নামাজ আদায় করা আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা একটি সাদকাহ, যা রাসূল (সা.) নির্দেশ করেছেন গ্রহণ করতে। এটি ইসলামের সহানুভূতি ও সহজিকরণের অন্যতম নিদর্শন।
মন্তব্য
কসর নামাজ ইসলামের সহনশীলতা ও সহজিকরণের নিদর্শন। ভ্রমণরত অবস্থায় মুসলিমদের উপর আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের অন্যতম উদাহরণ এটি। কসর নামাজের বিধান শুধু সহজতা নয়, এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, কোনো পরিস্থিতিতেই ফরজ ইবাদত ত্যাগ করার সুযোগ নেই।
মুসাফিরদের জন্য কসর নামাজ আদায় করা আল্লাহর নির্দেশিত একটি সাদকাহ, যা গ্রহণ করা মুসলিমদের জন্য আবশ্যক। ইসলামের এই নিয়ম মুসলিম জীবনে দৈনন্দিন ইবাদতকে সহজ ও সুসংহত করে।
"কসর নামাজের নিয়ম, কসর নামাজের মাসআলা" পোস্ট সম্পর্কিত মন্তব্যের জন্য নিচের কমেন্ট বক্ষে কমেন্ট করতে পারেন।
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url