সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত

সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য এই পোস্টটি তৈরি করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে সদকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা বিভিন্ন হাদিস ও কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই পোস্টে আমরা সদকার সংজ্ঞা, প্রকারভেদ এবং এর ফজিলত নিয়ে আলোচনা করবো।
সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত
চলুন যেনে নেওয়া যাক "সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত" সম্পর্কে বিস্তারিত।

ভূমিকা

ইসলামে সদকা একটি মহৎ ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রদান করা হয়। সদকা শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্য নয় বরং এটি মানুষের কল্যাণে যে কোন ধরণের সহায়তা হতে পারে। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, সদকা এমন একটি দান যা দাতার সম্পদে বরকত আনে এবং তার জীবনে সুখ শান্তি বৃদ্ধি করে।

সদকার প্রকারভেদ বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। যেমন, বাধ্যতামূলক সদকা (যাকাত), স্বেচ্ছাসেবী সদকা, এবং জীবিত অবস্থায় প্রদত্ত সদকা (সদকা জারিয়া)। প্রত্যেকটির গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

সদকার মাধ্যমে আপনি শুধু অন্যদের সাহায্য করেন না, বরং এটি আপনার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আখিরাতের মুক্তির একটি মাধ্যম। এ কারণে, মুসলিম সমাজে সদকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

সদকা কি

সদকা (আরবি: সাদকাহ, উর্দু: সাদকাহ) ইসলামিক পরিভাষায় এমন এক ধরনের স্বেচ্ছাদান, যা একান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রদান করা হয়। এটি যাকাতের মতো বাধ্যতামূলক নয়, বরং স্বেচ্ছামূলক। সদকা শুধুমাত্র অর্থ বা সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি সময়, শ্রম, জ্ঞান অথবা অন্য কোনো ধরণের সাহায্য হিসেবেও হতে পারে।
সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত
কুরআন অনুযায়ী, সদকা মানে স্বেচ্ছাসেবী নৈবেদ্য, যা মূলত দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে প্রদান করা হয়। ইসলামে সদকার মূল লক্ষ্য হলো সমাজের অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো।

সদকার আভিধানিক অর্থ

'সদকা' শব্দটি আরবি 'সিদক' মূল থেকে এসেছে, যার অর্থ "আন্তরিকতা"। এই শব্দের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে, কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা না করে, কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু দেওয়াকে বোঝানো হয়েছে। টি মূলত এমন দানের প্রতীক, যা সত্যিকারের বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইমাম জুরজানী বলেন, "যে দানের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সওয়াবের আশা করা হয়, সেটাই সদকা।" ইবনে মানজুর উল্লেখ করেন, "আল্লাহর জন্য গরীব মিসকিনদের জন্য যা দান করা হয়, সেটাই সদকা।"

সদকা কত প্রকার ও কি কি

ইসলামে সদকার গুরুত্ব অপরিসীম এবং এটি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। সদকা শুধু অর্থ বা সম্পদ দানে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিভিন্নভাবে করা যায় যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয়, যেমন-
Create an image showing the types of Sadaqah in Islam. Include scenes of a man giving food (Sadaqatul Fitr), building a mosque or well (Sadaqatul Jariyah), helping a poor person (General Sadaqah), sharing knowledge (Ilm Sadaqah), and removing an obstacle from a path (Everyday Sadaqah). The image should reflect the essence of Islamic charity and cultural values.

১. সদকাতুল ফিতর

রমজান মাসের শেষে ঈদের আগে প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য সদকাতুল ফিতর প্রদান বাধ্যতামূলক। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের সহায়তা করা যাতে তারা ঈদের দিনে খুশি অনুভব করতে পারে। এটি "ফিতরা" নামেও পরিচিত এবং এটি রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদকা।

ইবন উমার (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিটি মুসলিমের জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ করেছেন, তা সে গোলাম হোক, মুক্ত হোক, পুরুষ হোক বা নারী, প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা শিশু। এই সদকা আদায়ের জন্য খেজুর বা যব এক সা' পরিমাণ প্রদান করতে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আদেশ করেছেন যে, ঈদের সালাতের আগে এই সদকা প্রদান করতে হবে, যাতে সবার জন্য ঈদ আনন্দময় হয়। (সহীহ বুখারী)

২. সদকাতুল জারিয়া

সদকাতুল জারিয়া একটি স্থায়ী সদকা, যা মৃত্যুর পরেও দানকারীর জন্য সওয়াবের উৎস হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ- মসজিদ নির্মাণ, পানির কূপ স্থাপন বা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা—এসবই সদকাতুল জারিয়া হিসেবে গণ্য হয়।

হজরত আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যখন একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল থেমে যায়। তবে তিনটি বিষয় রয়েছে যেগুলোর সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকে: সদকায়ে জারিয়া, এমন উপকারী জ্ঞান যা অন্যদের উপকারে আসে এবং সৎ সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম, হাদিস, ৪৩১০)

৩. সাধারণ সদকা

এটি এমন দান, যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হয় এবং বাধ্যতামূলক নয়। সাধারণত, কোনো গরীব, অসহায় বা অভাবীকে সাহায্য করতে এই সদকা প্রদান করা হয়। এটি "ইসলামে সাধারণ সদকা" বা "স্বেচ্ছা সদকা" নামে সার্চ করা হয়।

৪. ইলম বা জ্ঞান সদকা

যে কোনো জ্ঞান বা শিক্ষা, যা অন্যের উপকারে আসে এবং দীর্ঘমেয়াদে সমাজে ভালো প্রভাব ফেলে, সেটাও সদকা হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামিক বই বিতরণ, দীনী শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি।

৫. সদকা হিসেবে প্রতিদিনকার ছোট কাজ

কোনো মুসকিল আসানের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট সদকা করা যেমন রাস্তায় থেকে কাঁটা, পাথর বা বিপদজনক কিছু সরিয়ে ফেলা। এসব কাজকেও "ছোট ছোট সদকা" হিসেবে ধরা হয় এবং এগুলোর ফজিলত অনেক।

সদকার ফজিলত

ইসলামে সদকা একটি মহান এবং বরকতময় আমল হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধু দান বা অর্থ প্রদান নয়, বরং যে কোনো ধরনের সহায়তা, সমর্থন বা সাহায্য করা সদকার অন্তর্ভুক্ত। সদকা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করে, সম্পর্কের উন্নতি ঘটায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়। কুরআন ও হাদিসে সদকার অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত

১. হালাল উপার্জনের সদকার ফজিলত

হালাল উপার্জনের সদকা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং এটি এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।

সায়ীদ ইবনে ইয়াসার (রহ.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি হালাল উপায়ে অর্জিত মাল থেকে সদকা করে, আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র পবিত্র (হালাল) জিনিসই গ্রহণ করেন। সেই সদকা আল্লাহর হাতে দেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হয়, এবং আল্লাহ তা’আলা সেই সদকাকে লালন-পালন করেন, যেমন তোমরা ঘোড়া বা উটের বাচ্চাকে লালন করো। অবশেষে সেই সদকা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তা পাহাড়ের মতো বড় হয়ে যায়।" ( মুয়াত্তা মালিক) হাদিসের মানঃ তাহকীক অপেক্ষমাণ।

২. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন

সদকা এমন একটি আমল, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, "তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে, তার পুরস্কার তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে।" (সুরা বাকারা, আয়াত ২৭২)

আবু তালহা (রাঃ)-এর উদারতা: প্রিয় বাগান 'বাইরহা' আল্লাহর পথে দান

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন, মদীনার আনসারগণের মধ্যে আবু তালহা (রাঃ) ছিলেন অন্যতম ধনী ব্যক্তি, যার বিশাল খেজুর বাগান ছিল। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল 'বাইরহা' নামক একটি বাগান, যা মসজিদে নববীর সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। বাগানটির বিশেষত্ব ছিল সেখানকার সুমিষ্ট ও শীতল পানি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই পান করতেন।

একদিন, আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে আয়াত নাযিল হলো: "তোমরা কখনো সওয়াব লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের প্রিয় বস্তু খরচ করবে" (আল ইমরান, ৩:৯২)। এই আয়াত শুনে আবু তালহা (রাঃ) দ্রুত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হচ্ছে এই 'বাইরহা' বাগান। আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এটিকে দান করলাম, যাতে এর বিনিময়ে আমি নেকি পেতে পারি। আপনি যেভাবে ইচ্ছা, এটিকে ব্যবহার করুন।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবু তালহার (রাঃ) দানের প্রশংসা করে বললেন, “বাহবা! এটা অত্যন্ত লাভজনক সম্পদ। তবে আমি মনে করি, তুমি এটি তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করে দাও।” আবু তালহা (রাঃ) সে পরামর্শ মেনে বাগানটি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। (মুয়াত্তা মালিক)

এটি ছিল আবু তালহা (রাঃ)-এর উদারতা ও আল্লাহর প্রতি নিবেদন, যা পরবর্তী মুসলিমদের জন্য একটি মহান উদাহরণ হিসেবে থেকে গেছে।

৩. সদকার ফজিলত, ছোট দানকেও তুচ্ছ মনে না করার শিক্ষা

সদকার মূলত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আন্তরিকতা। তাই এমনকি সামান্য কিছু দানও উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এটি একটি মহান আমল হতে পারে।

আমর ইবনে মুয়াজ আশহালী তাঁর দাদীর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে মুমিন নারীগণ, তোমাদের কেউ যেন তার প্রতিবেশীর প্রতি দানকে তুচ্ছ মনে না করে, এমনকি যদি তা একটি পোড়া ছাগলের খুরও হয়, তবুও তা কবুল করো।” (মুয়াত্তা মালিক)

এই হাদিসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শিক্ষাদান করেছেন যে, দানের পরিমাণ বড় বা ছোট যাই হোক না কেন, তা মূল্যবান।

৪. উত্তম প্রতিদান

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে একদিন একজন ভিক্ষুক কিছু চাইতে আসেন। সে সময় আয়েশা (রাঃ) রোযা রেখেছিলেন এবং ঘরে মাত্র একটি রুটি ছিল, যা তাঁর ইফতারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তিনি তাঁর দাসীকে বললেন, “উহা ফকীরকে দাও।” দাসী বিস্মিত হয়ে বললেন, “আপনার ইফতারের জন্য কিছুই থাকবে না।” তবুও আয়েশা (রাঃ) বললেন, “দিয়ে দাও।”

দাসী সেই রুটি ভিক্ষুককে দিয়ে দিল। সন্ধ্যা হলে হঠাৎ একটি বাড়ি থেকে ছাগলের ভূনা মাংস উপহার হিসেবে এসে পৌঁছাল। আয়েশা (রাঃ) তখন দাসীকে ডাকলেন এবং বললেন, “এই মাংস তোমার রুটির চেয়ে উত্তম।” (মুয়াত্তা মালিক)

এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, দান করলে আল্লাহ কখনো কাউকে বঞ্চিত রাখেন না। আয়েশা (রাঃ)-এর ত্যাগের ফলে আল্লাহ তাঁকে এর চেয়েও উত্তম প্রতিদান দিয়েছিলেন, যা সদকার বরকত ও মহানতা তুলে ধরে।

৫. পাপ মোচন

সদকা পাপ মোচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। হাদিসে বলা হয়েছে, "সদকা পাপকে নিভিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।" (তিরমিজি)

৬. সম্পদে বরকত আনা

যারা সদকা করে, তাদের সম্পদে বরকত হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, "মানুষের সম্পদ সদকার দ্বারা কমে না বরং বাড়ে।" (মুসলিম)

৭. প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা

সদকা বিপদ, দুঃখ ও অসুবিধা থেকে রক্ষা করে। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধকে শান্ত করে এবং মানুষকে অপ্রত্যাশিত ও খারাপ মৃত্যুর হাত থেকে সুরক্ষা দেয়।” (তিরমিজি)

৮. কিয়ামতের দিনে ছায়া

কিয়ামতের দিন যেদিন কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সদকা করা ব্যক্তি তার সদকার দ্বারা ছায়া পাবে। হাদিসে এসেছে, "প্রত্যেক ব্যক্তি তার সদকার ছায়ায় থাকবে, যতক্ষণ না বিচার শেষ হয়।" (সহীহুল জামে‘, হাদীস নং ৪৫১০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন: “নিশ্চয়ই সদকা কবরের যন্ত্রণা ও তাপ থেকে মুক্তি দেয়। কিয়ামতের দিন মুমিন তার সদকার ছায়ায় আশ্রয় পাবে।” (সিলসিলাহ সহীহাহ: খণ্ড ৭।)

৯. স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু

হাদিসে বলা হয়েছে, "সদকা রোগের চিকিৎসা এবং আয়ু বৃদ্ধি করে।" (আহমাদ)

জানের সদকা কি

জাণের সদকা বলতে এমন সদকা বা দানকে বোঝানো হয়, যেখানে কোনো ব্যক্তি তার জীবন বা তার কোনো প্রিয়জনের জীবন রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং সুস্থতার পর তা পূর্ণ করার মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করে। 

এটি এক ধরনের মানত, যেখানে কেউ আল্লাহর কাছে কোনো বিপদ থেকে মুক্তি, রোগ থেকে আরোগ্য বা অন্য কোনো বিশেষ দোয়া কবুলের জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দান বা কুরবানি করেন।

জাণের সদকার মূল প্রেক্ষাপট

জানের সদকা সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে করা হয়, যখন কেউ গুরুতর অসুস্থ থাকে বা তার জীবনের ওপর বড় ধরনের বিপদ আসে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন যে, যদি ওই ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠে বা বিপদ থেকে রক্ষা পায়, তাহলে তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি পশু কুরবানি দেবেন বা কোনো ধরনের দান করবেন। 
সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত
এটিকে বাংলায় "জানের বদলে জান সদকা" বলা হয়, অর্থাৎ নিজের বা প্রিয়জনের জীবনের পরিবর্তে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি কুরবানি বা সদকা করা।

জান সদকার ধরন

জান সদকার সাধারণত নিম্নোক্ত কয়েকটি ধরন রয়েছে:
  • পশু কুরবানি: কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মানত করেন যে, তিনি সুস্থ হলে বা কোনো বিপদ থেকে মুক্তি পেলে একটি গরু, ছাগল বা ভেড়া আল্লাহর নামে কুরবানি করবেন। এটি জান সদকার সবচেয়ে প্রচলিত ধরন।
  • মানত বা প্রতিশ্রুতি পূরণ: কেউ মানত করেন যে, যদি আল্লাহ তার কোনো বিশেষ প্রার্থনা কবুল করেন, তিনি আল্লাহর নামে কিছু দান করবেন। এ দান হতে পারে অর্থ, খাদ্য বা অন্য কোনো বস্তু।

জানের সদকা দেওয়ার নিয়ম

জানের সদকা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে ইসলামে বিশেষ কিছু বিধান রয়েছে, যেগুলো মান্য করে এই সদকা আদায় করতে হয়। এটি সাধারণত একটি পশু কুরবানি বা দান হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়, যখন কোনো ব্যক্তি বা তার প্রিয়জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানত করে যে, সুস্থ হলে পশু কুরবানি বা দান করা হবে।

১. মানতের নিয়ত

জানের সদকা সাধারণত কোনো বিপদ, রোগ বা অসুস্থতার সময়ে করা হয়। ব্যক্তি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানত করে যে, যদি আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দেন বা বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তবে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি দেবেন অথবা দান করবেন।

এই নিয়তটি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং নেক কাজ হিসেবে করতে হয়। এটি হতে হবে শিরক বা অন্য কোনো ভুল উদ্দেশ্যে মুক্ত।

২. পশু কুরবানি (যদি পশু সদকা করা হয়)

  • পশু হিসেবে সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া বা অন্য কোনো হালাল পশু কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানির পশু অবশ্যই সুস্থ ও নির্দিষ্ট ইসলামী শর্ত পূরণকারী হতে হবে।
  • কুরবানি করার সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর” বলে আল্লাহর নামে পশু জবাই করতে হয়, এবং এই কুরবানির উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হওয়া উচিত।
  • কুরবানির মাংস গরিব, অসহায় ও দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

৩. দান (যদি পশু কুরবানি না করে অর্থ বা সম্পদ সদকা করা হয়)

  • যদি মানত করা হয় যে সুস্থতার পর সম্পদ, অর্থ, বা অন্য কিছু দান করা হবে, তাহলে সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তা গরিব, দুস্থ, বা প্রয়োজনমতো অন্যান্য মানুষকে দেওয়া যেতে পারে।
  • এই দান অবশ্যই সম্পূর্ণ সততা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতে হবে।

৪. সদকার জন্য সময়

জানের সদকা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে আল্লাহর কাছে করা মানত পূরণ করতে বিলম্ব করা উচিত নয়। আল্লাহ যদি সেই ব্যক্তি বা তার প্রিয়জনকে সুস্থ করে দেন বা বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব মানত পূর্ণ করা উচিত।

৫. প্রকাশ্যে বা গোপনে দেওয়া

জানের সদকা প্রকাশ্যে বা গোপনে দেওয়া যেতে পারে। তবে গোপনে সদকা দেওয়া উত্তম, কারণ এতে রিয়া বা লোক দেখানোর আশঙ্কা কম থাকে। আল্লাহ গোপনে করা সদকা বেশি পছন্দ করেন।

জান ত্যাগের বদলে জানের দান, সদকা এবং কুরবানি: শরিয়তের দৃষ্টিকোণ

মান্নত হিসেবে জানের বদলে (হালাল পশুর) জানের দান, সদকা, অথবা কুরবানি করা শর্তসাপেক্ষে নিষেধ নয়। তবে, এ ধরনের মান্নতের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ ও উপযুক্ত পশু কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব হবে।

কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কুরবানির ঐতিহাসিক ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।’ (সুরা সাফফাত, ১০৭ আয়াত)।

তাবিঈ ইকরামা (রহ.)-এর মাধ্যমে জানা যায় যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এমন একজন ব্যক্তির জন্য ফতওয়া দিয়েছিলেন যে নিজের জান কুরবানি করা আবশ্যক করে নিয়েছে। তিনি জানের পরিবর্তে ১০০ উট কুরবানি করার নির্দেশ দেন। তবে, পরে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যদি আমি একটির পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি করার ফতওয়া দিতাম, তবে সেটিই যথেষ্ট হতো। কেননা, আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন: ‘আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।’ (তাফসির ইবন কাসীর- ১২/৪৪)।

তদনুসারে, যদি কেউ এ ধরনের মান্নত করে, তবে তাকে একটি গরু অথবা এক বছর বা তার অধিক বয়সী একটি ছাগল বা বকরী গরীব-মিসকীনদের দান করতে হবে, অথবা এটি কোনো মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং-এ দান করা উচিত। এভাবে তার মান্নত পূরণ করা ওয়াজিব।

এমনকি, যদিও শরিয়তে মান্নত নিষেধ নয়, তা হলেও এটি অত্যন্ত পছন্দনীয় নয়। শরিয়ত নফল সদকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু মান্নতের প্রতি নয়।

সর্বোত্তম সদকা কি

ইসলামে সর্বোত্তম সদকা হলো সেই দান, যা কোনো ব্যক্তির জীবনের এমন সময়ে করা হয়, যখন তার দানের ইচ্ছা খুব কম থাকে এবং নিজের জন্য সম্পদ ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে। সাধারণত, মানুষ যখন সুস্থ, সক্রিয় এবং সম্পদের প্রতি আসক্ত থাকে, তখন দান করা কঠিন হয়। 

কেননা, তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকে এবং সম্পদ ধরে রাখার চেষ্টা করে। তাই যখন মানুষ এই অবস্থাতেও দান করে, তখন তা সবচেয়ে উত্তম সদকা হিসেবে গণ্য হয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার লোভ, ভয় ও সংশয়কে অতিক্রম করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে।

সর্বোত্তম সদকা সংক্রান্ত হাদিস

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! উত্তম সদকা কী?” তিনি উত্তর দিলেন, “তোমার সুস্থ অবস্থায়, যখন সম্পদের প্রতি লোভ থাকে এবং তুমি দারিদ্র্যের ভয় পাও, তখন দান করাই উত্তম সদকা। আর এমন বিলম্ব করো না যে, যখন তোমার প্রাণ কণ্ঠনালীতে পৌঁছে যায়, তখন তুমি বলতে শুরু করবে, ‘এটা অমুকের জন্য এবং এটা অমুকের জন্য’—তখন সেই সম্পদ তো অমুকেরই হয়ে গেছে।” (সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ২২৫৪)

হাদিসের ব্যাখ্যা

  • সুস্থ অবস্থায় সদকা করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সদকা তখনই সর্বোত্তম, যখন একজন ব্যক্তি সুস্থ থাকে এবং তার সম্পদের প্রতি আকর্ষণ থাকে। সুস্থ অবস্থায় মানুষ সাধারণত সম্পদ ধরে রাখতে চায়, কারণ ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। এ সময়ে দান করা কঠিন হলেও তা সবচেয়ে মূল্যবান, কারণ তখন নিজের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করা হয়।
  • সম্পদের প্রতি লোভ ও দারিদ্র্যের ভয়
যখন কেউ নিজের সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট থাকে এবং ভবিষ্যতে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয় করে, সেই সময়ে দান করাই সত্যিকারের পরীক্ষা। কারণ এ সময়ে মানুষ সাধারণত বেশি করে সম্পদ জমা করার দিকে মনোযোগ দেয়। কিন্তু যারা এই অবস্থায়ও দান করেন, তারা নিজেদের লোভ ও ভয়কে পরাজিত করেন এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন।
  • মৃত্যুর সময় দান না করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছেন, এমন দান করার ব্যাপারে, যা মৃত্যুর আগে শেষ মুহূর্তে করা হয়। যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং তার সম্পদ কোথায় যাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তখন দান করার কোনো মহত্ত্ব নেই, কারণ তখন তার দান কোনো ইচ্ছাকৃত নেকির কাজ নয় বরং অবশ্যম্ভাবী কিছু। এমন দান আর "ইচ্ছাকৃত সদকা" হিসেবে গণ্য হয় না।
  • মূল শিক্ষা
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, সর্বোত্তম সদকা তখনই হয়, যখন তা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং নিজস্ব লোভ ও ভয় অতিক্রম করে করা হয়। মৃত্যুর সময় দান করার চেয়ে, সুস্থ অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করাই সর্বোত্তম।

দান ও সদকার পার্থক্য

ইসলামের প্রেক্ষাপটে দান এবং সদকা মূলত একই জিনিসকে বোঝায় এবং এদের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অপরকে সহায়তা করার জন্য সম্পদ, উপহার বা সাহায্য প্রদানকে বোঝায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দান এবং সদকার ব্যবহার বা উপলব্ধি ভিন্নভাবে হতে পারে, তবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের উদ্দেশ্য একই—সামাজিক কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

দান ও সদকার মধ্যে পার্থক্য থাকার সম্ভাব্য কারণ-
  • শব্দের ব্যবহার
    • দান শব্দটি সাধারণত বাংলায় ব্যবহৃত হয় এবং এর অর্থ হলো অর্থ, সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ কারো জন্য প্রদান করা।
    • সদকা আরবি শব্দ, যা মূলত ইসলামে ব্যবহৃত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে কোনো ভালো কাজকেই বোঝায়।
  • ইসলামী শিক্ষা
    • ইসলামে সদকা অর্থ শুধুমাত্র অর্থ বা সম্পদ প্রদান নয়, বরং আল্লাহর জন্য যেকোনো ভালো কাজ। যেমন, অন্যকে সাহায্য করা, কাউকে উপকার করা, অথবা এমনকি কাউকে হাসিখুশি করা বা কষ্ট লাঘব করাও সদকা।
    • দান শব্দটি সাধারণত সম্পদ বা সামগ্রী প্রদানের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • একই উদ্দেশ্য
    • উভয় ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানুষের কল্যাণ করা। তাই ইসলামে দান ও সদকা একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এবং পার্থক্য অদৌ বিশেষভাবে নেই।

সদকা সম্পর্কে আয়াত

ইসলামে সদকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। সদকা বিশেষভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পদ, শ্রম বা সহায়তা প্রদানকে বোঝায়। কোরআনে সরাসরি সদকার ফজিলত ও গুরুত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত উল্লেখ রয়েছে। নিচে শুধু সদকা সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত তুলে ধরা হলো:

১. গোপন ও প্রকাশ্য সদকা

"তোমরা যদি প্রকাশ্যে সদকা দাও, তবে তা কতই না উত্তম! আর যদি গোপনে দাও এবং গরিবদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম।"
(সূরা আল-বাকারা, ২:২৭১)

২. যারা সদকা দেয় তাদের পুরস্কার

"পুরস্কার তাদেরই জন্য, যারা নিজেদের ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে রাতেও এবং দিনেও, গোপনে ও প্রকাশ্যে; তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা কোনো দুঃখিতও হবে না।"
(সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৪)

৩. সদকা দিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করা

"তুমি তাদের ধনসম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ কর, এর মাধ্যমে তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবে, এবং তাদের জন্য দোয়া করো।"
(সূরা আত-তাওবা, ৯:১০৩)

৪. অভাবগ্রস্তদের জন্য সদকা

"সদকা তো হলো ফকিরদের, মিসকিনদের, সদকা সংগ্রহকারীদের, তাদের অন্তর আকৃষ্ট করার জন্য, গোলামদের মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের, আল্লাহর পথে ব্যয় এবং মুসাফিরদের জন্য।"
(সূরা আত-তাওবা, ৯:৬০)

৫. ভালো কাজ ও সদকা

"যে কেউ একটি ভালো কাজ করে, তাকে তার দশ গুণ প্রতিদান দেওয়া হবে।"
(সূরা আল-আন'আম, ৬:১৬০)

৬. সদকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি

"তাদের উদাহরণ যারা তাদের ধনসম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং নিজেদের ঈমানের দৃঢ়তার জন্য ব্যয় করে, তা একটি বাগানের মতো যার মধ্যে প্রচুর ফল হয়।"
(সূরা আল-বাকারা, ২:২৬৫)

৭. সদকা ও আত্মিক উন্নতি

"তোমরা কখনো পূর্ণ ধার্মিকতায় পৌঁছতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা সেই জিনিস থেকে দান করবে যা তোমরা ভালোবাসো।"
(সূরা আলে ইমরান, ৩:৯২)

এই আয়াতগুলোতে শুধু সদকা সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে, যা মানুষকে শুদ্ধ করে, তাদের সম্পদের বারাকাহ বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর কাছে প্রতিদান লাভের উপায় হিসেবে কাজ করে।

সদকা সম্পর্কে হাদিস

ইসলামে সদকা শুধুমাত্র দান-খয়রাতের মাধ্যম নয়, বরং এটি মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বরকত এবং কল্যাণ বয়ে আনে। এটি শুধু সম্পদশালী নয়, দরিদ্র মুসলমানদের জন্যও একটি অনন্য ইবাদত, যেখানে প্রতিটি ভালো কাজকে সদকা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যেকোনো কিছু দান বা সাহায্য করলেই তা সদকা হিসেবে বিবেচিত হয়। নিচে সদকা সম্পর্কিত কিছু বিশুদ্ধ (সহিহ) হাদিস বর্ণিত হলো-

১. পরিবারের জন্য খরচ করাও সদকা

হাজ্জাজ ইবনু মিনহাল (রহঃ) ... আবূ মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

“মানুষ যখন তার পরিবারের জন্য সওয়াবের নিয়তে খরচ করে, তখন তা সদকা স্বরূপ গণ্য হয়।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৫৩)

২. সাদকাদাতার জন্য নবীজির দোয়া

হাফ্‌স ইবনু ’উমর (রহঃ) ... ’আবদুল্লাহ ইবনু আবূ আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“লোকজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তাদের সাদকা নিয়ে আসত, আর তিনি বলতেনঃ ‘হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।’ একদিন আমার পিতা সাদকা নিয়ে হাজির হলে তিনি দোয়া করলেনঃ ‘হে আল্লাহ! আবূ আওফার বংশধরদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।’”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১৪১০)

৩. ফিতনার কাফফারা

’আলী ইবনু ’আবদুল্লাহ (রহঃ) ... হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“পরিবার, ধন-সম্পদ এবং প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কিত ফিতনার কাফফারা হলো সালাত, সাওম এবং সদকা।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ১৭৭৪)

৪. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করাও সদকা

হাম্মাম (রহঃ) ... আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা সদকা স্বরূপ।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৩০৫)

৫. প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সদকা

ইসহাক (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“প্রত্যেক দিন সূর্য উদিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের প্রতিটি জোড়া (হাড়ের জন্য) একটি সদকা রয়েছে। দুজন লোকের মধ্যে সুবিচার করাও সদকা, কাউকে সাহায্য করে তার সওয়ারিতে আরোহণ করানো বা তার মালপত্র তুলে দেওয়া সদকা, ভালো কথা বলা সদকা এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করাও সদকা।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৭৮১)

৬. প্রতিটি কল্যাণকর কাজই সদকা

কুতায়বা ইবনু সাঈদ ও আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) ... হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“প্রত্যেক কল্যাণকর কাজই সদকা।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২২০০)

৭. বিত্তবানদের জন্য সতর্কবাণী

শায়বান ইবনু ফাররুখ (রহঃ) ... আহকাফ ইবনু কায়স (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আবূ যার (রাঃ) বলেন,

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সম্পদ সঞ্চয়কারীদের জন্য সুসংবাদ, যাদের পৃষ্ঠদেশ গরম লোহার দ্বারা দাগানো হবে এবং তা তাদের দেহের হাড় দিয়ে বের হবে। এই দাগ তাদের ঘাড়ের দিক দিয়েও বের হবে।”
(সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২১৭৯)

৮. জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উপায়

আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকের সাথে আল্লাহ অবশ্যই কথা বলবেন এবং তার সাথে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে কোন দোভাষী থাকবে না। তারপর বান্দা তার ডান দিকে তাকাবে, কিন্তু তার কৃতকর্মগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। আবার বাম দিকে তাকাবে, তখনও তার কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। এরপর সামনে তাকালে শুধু জাহান্নামের আগুন দেখতে পাবে। সুতরাং, এক টুকরা খেজুর সদকা করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।”
(সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ২২২০)

৯. উত্তম সদকা

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! উত্তম সদকা কী?” তিনি উত্তর দিলেন, “তোমার সুস্থ অবস্থায়, যখন সম্পদের প্রতি লোভ থাকে এবং তুমি দারিদ্র্যের ভয় পাও, তখন দান করাই উত্তম সদকা। আর এমন বিলম্ব করো না যে, যখন তোমার প্রাণ কণ্ঠনালীতে পৌঁছে যায়, তখন তুমি বলতে শুরু করবে, ‘এটা অমুকের জন্য এবং এটা অমুকের জন্য’—তখন সেই সম্পদ তো অমুকেরই হয়ে গেছে।”
(সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ২২৫৪)

১০. সদাকাতুল ফিতর

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে সদাকাতুল ফিতর বাবদ এক সা’ গম বা খেজুর বা যব বা পনির বা কিসমিস দান করতাম। মুয়াবিয়া (রাঃ) মাদীনায় এসে বললেন, “শাম দেশের উত্তম গমের দু’ মুদ্দ (এক সা’র সমান) এখানকার এক সা’ এর সমান।” তবে আমি সারা জীবন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগের নিয়ম অনুযায়ী সদাকাতুল ফিতর পরিশোধ করে যাবো।
(সুনান ইবনু মাজাহ: ৫/১৮২৯)

১১. অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া নিষেধ

আবূ যার (রাঃ) বলেন, আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, “সর্বোত্তম কাজ কী?” তিনি বললেন, “আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদ।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন ক্রীতদাস মুক্ত করা শ্রেষ্ঠ?” তিনি বললেন, “যা মূল্যবান এবং তার পরিবারের জন্য উত্তম।” আমি আবার বললাম, “আমি যদি তা না পারি?” তিনি বললেন, “তবে কোন কারিগরের সহযোগিতা করো অথবা কাজ করে দাও।” আমি বললাম, “তাও যদি না পারি?” তিনি বললেন, “তাহলে মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকো। এটিই তোমার পক্ষ থেকে সদকা।”
(সহীহ বুখারী: ২৫১৮, সহীহ মুসলিম: ২৬০)

১২. সুস্থ অবস্থায় দানের গুরুত্ব

রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বলেন, “উত্তম সদকা হলো, যখন তুমি সুস্থ থাকো এবং সম্পদের প্রতি আকর্ষণ থাকে, তখন দান করা। দানের সময় দারিদ্র্যের ভয় যেন বাধা না দেয়।” এটাই হলো উত্তম সদকা।
(সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ২২৫৪)

উপসংহার

সদকা এমন একটি ইবাদত যা মানুষকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যায় এবং তার জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি এনে দেয়। হাদিস ও কুরআনের আলোকে সদকার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, আমাদের উচিত সদকা প্রদান করে নিজের জীবনকে আরও অর্থবহ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! "সদকা কি, সদকার অর্থ, প্রকারভেদ ও ফজিলত, সদকা সম্পর্কে হাদিস ও আয়াত" এই পোস্টটি পড়ে আপনার কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে, দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে শেয়ার করুন। আপনার মতামত আমাদের ভবিষ্যতের পোস্টগুলিকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে।

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো!

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url