বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা ২০ পয়েন্ট
বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও তার সমাধানের উপর আলোকপাত করে। প্রতিবছর বর্ষার সময় বন্যার কারণে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জনজীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। সঠিক প্রতিরোধ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যার প্রভাব কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা নিয়ে এই পোস্টে বন্যার কারণ, প্রভাব এবং এর প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক - বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত, যেখানে উঠে এসেছে বন্যার প্রকৃতি ও এর মোকাবেলার উপায়। এই লেখাটি আপনাকে সমস্যাটি বোঝার পাশাপাশি সমাধানের সঠিক ধারণা দেবে।
১. ভূমিকা
বাংলাদেশ হচ্ছে প্রকৃতির রূপসী কন্যা। বাংলাদেশের মানুষ আবহমানকাল ধরেই বন্যা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত। তবে কখনো কখনো এই প্রকৃতি পাগলের রূপ ধারণ করে থাকে। আর এই প্রকৃতির পাগলের রূপকেই বলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের কোন না কোন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর সম্মুক্ষিন হয়ে থাকে।
ঋতু চক্রের আবর্তনের মতো বন্যা ও প্লাবন আমাদের দেশে নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের বহু মানুষ বন্যায় ডুবে যায় যার ফলে এই বন্যা থেকে বাঁচার জন্য কিছু প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় যা আমরা বন্যার প্রতিকার হিসেবে বিবেচনা করে থাকি।
বাংলাদেশে তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে, যেখানে পাহাড়, নদ-নদী এবং সমভূমি মিশ্রিত, বন্যার ঝুঁকি বেশি। তবে বন্যা শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, মানুষের কর্মকান্ড যেমন বৃক্ষ নিধন, নদী ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণও এর প্রধান কারন। এই পোস্টে বাংলাদেশের বন্যা ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এ সমস্যার প্রতিকারে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা ২০ পয়েন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত।
২. বন্যা কাকে বলে?
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, নদী বা সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি অথবা ভূমির নিচের পানি স্তরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বন্যা হয়ে থাকে। সাধারণত বর্ষা বা বৃষ্টির পানিতে কোনো এলাকা প্লাবিত হলেই তাকে বন্যা বলা হয়। তবে আমাদের বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞাটি একটু ভিন্ন ধরনের।
আমাদের দেশে নদীর দুকুল ঝাপিয়ে দুপাশের ভূমি ডুবে গেলেই তা বন্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অবিরত বর্ষণে অথবা ভারত থেকে আসা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে যখন আবাসিক এলাকা প্লাবিত হয় এবং মানুষের বাড়িঘর, শস্য, রাস্তাঘাট তথা অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়ে তখন তাকে বন্যা বলা হয়।
৩. বন্যার প্রকারভেদ
বন্যার প্রকারভেদ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যা মূলত বিভিন্ন পরিস্থিতি ও কারনে ঘটে। বাংলাদেশে সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বন্যা দেখা যায়। তবে বর্ষার পরেও অনেক সময় বন্যা দেখতে পাওয়া যায়। তবে সকল বন্যার ধরন বা প্রকৃতি একই হয় না। প্রতিটি ধরনের বন্যা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, কারণ এবং প্রভাব সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে সাধারণত চার ধরনের বন্যা বেশি দেখা যায়।
৩.১. ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড বা আকস্মিক বন্যা
বাংলাদেশে ফ্ল্যাড বা আকস্মিক বন্যা এমন এক প্রকার বন্যা যা খুব দ্রæত এবং হঠাৎ ঘটে। সাধারণত কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড বা আকস্মিক বন্যা ঘটে থাকে। এই বন্যা মানুষের জন্য অত্যন্ত বিপদ এবং জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ভূমিধস, নদী বা খালের জলধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করা অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্টি কারনে হয়ে থাকে। যেহেতু এই বন্যাটি আকস্মিক ঘটে তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে এর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং পল্লী,শহর, গ্রামসহ বৃহত্তর অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যেতে পারে।
হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত বন্যা হওয়ার ফলে আগে থেকেই কোন প্রকার প্রস্ততি নেওয়া বা উদ্ধার কাজ শুরু করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এই বন্যায় পানি প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে জলস্তর বাড়তে থাকে যা আশপাশের অঞ্চলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
যেহেতু খুব অল্প সময়ে বন্যাটি ঘটে সেহেতু খুব অল্প সময়ের মধ্যে বন্যার পানি নামতেও শুরু করে। সাধারণত পাহাড়ী ঢল থেকে এই বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৩.২. বৃষ্টিবিধৗত বন্যা
বৃষ্টিবিধৗত বন্যা হলো এমন একটি বন্যা যা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই বন্যা মূলত শহর বা গ্রামের নিকাশী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যাওয়ার কারনে হয়ে থাকে। এই প্রকার বন্যায় অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নদী বা খালের বাইরে বেরিয়ে আশপাশের অঞ্চলগুলোকে ডুবিয়ে দেয়।
অতি বৃষ্টির কারনে জমে থাকা পানি দ্রæত প্রবাহিত হয়ে একাধিক এলাকা প্লাবিত হতে পারে এবং এটি আকস্মিক বন্যার রূপ ধারন করে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারনে নদী বা খালের পানি অসাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়। এই ধরনের বন্যা দীর্ঘ মেয়াদী হতে পারে কারণ নদীর পানির স্তর খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পায়।
মূলত শহরে যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয় এবং নিকাশী ব্যবস্থা ভাল না থাকার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রæত জমে গিয়ে শহর বা নগরী গুলো ডুবে যায়। সড়ক, বাড়িঘর, দোকান পাট ইত্যাদি ডুবে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে।
৩.৩. সমুদ্রোপকূলীয় বন্যা
মূলত সমুদ্রোপকূলীয় বন্যা তখনই ঘটে যখন সমুদ্রের পানি উপকূলীয় অঞ্চলের ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং উপকূলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। এই বন্যা সাধারণত সুনামি, ঘূণিঝড়, জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি বা সমুদ্রের স্তরের দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধি (যেমন গ্লোবাল ওয়র্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব) এর কারণে ঘটে থাকে।
সমুদ্রোপকূলীয় বন্যা সাধারণত শুষ্ক অঞ্চলে ঘটে না, তবে নিচু উপকূলীয় অঞ্চলগুলো, যেখানে মানুষের বসতি ও কৃষি কাজের জন্য ভূমি ব্যবহার হয়, সেখানে এটি বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সমুদ্রোপকূলীয় বন্যাকে কয়েক প্রকারে বিভক্ত করা যেতে পারে। যার কিছু প্রাকৃতিকভাবে হয়ে থাকে আর কিছু মানবসৃষ্ট কারণে হয়ে থাকে। যেমন:-
- নমিত বন্যা: নমিত বন্যা তখন ঘটে যখন সাধারণত জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানি তার স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলে উপকূলের কিছু অংশ প্লাবিত হয়ে যায়।
- ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের কারণে বন্যা: ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের কারণে সমুদ্রের স্তর দ্রæত বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি, ঝড় এবং ঢেউয়ের কারণে সমুদ্রের পানি উপকূলে প্রবাহিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হয়।
- সুনামি: সুনামি একটি মহাদেশীয় বা সাগরীয় ভূমিকম্প বা তীব্র শোকের কারণে সৃষ্টি হওয়া বিপজ্জনক এবং ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে এমন এক ধরনের সমুদ্রোপকূলীয় বন্যা। সুনামি সাধারণত খুব দ্রুত ঘটে এবং বিশাল আকারে ভূমি প্লাবিত করে।
- উচ্চ জলস্তরের কারণে বন্যা: এই ধরনের বন্যা ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের ফলে সৃষ্ট ঝড়ের কারণে সমুদ্রের পানি উপকূলে ঢুকে পড়ে এবং ভূমি প্লাবিত হয়ে যায়। এটি সাধারণত তীব্র ঝড়ের সাথে থাকে এবং শক্তিশালী বাতাসের কারণে পানির স্তর দ্রুত বেড়ে যায়।
- সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধি: গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর সমুদ্রস্তর বাড়ছে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদী বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৩.৪. মৌসুমি বন্যা
মৌসুমি বন্যা এমন একটি ধরনের বন্যা যা নির্দিষ্ট ঋতু বা মৌসুমে ঘটে এবং সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, নদী বা খালগুলোর পানি বাড়ার কারণে হয়। মৌসুমি বন্যার ঘটনা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে, তবে বিশেষত তাপমণ্ডলীয় এবং উপতাপমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে এই ধরনের বন্যা অনেক বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে মৌসুমি বন্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে, বিশেষত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টি হয়।
৪. বন্যা কেন হয়?
বাংলাদেশ হচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। বাংলাদেশে ঋতুচক্রের পালাবদলে মোট ছয়টি ঋতু- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ভিন্নতা দিয়েছে যা পুরো বিশ্বে বিরল। বছরের বেশির ভাগ সময়ই যেমন প্রচন্ড গরম থাকে তেমনি বেশ কয়েক মাস প্রচন্ড বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে। তবে বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে বন্যা দুই ধরনের হয়ে থাকে।
- প্রাকৃতিক কারন
- মানবসৃষ্ট কারন বা কৃত্রিম কারন।
নিচে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
৪.১. প্রাকৃতিক কারন
বাংলাদেশ প্রতি বছরই বন্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বন্যা একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে বন্যা হওয়ার পিছনে বেশকিছু কারনও রয়েছে। বাংলাদেশের ভূগোল, জলবায়ু, নদী ব্যবস্থাপনা এবং মৌসুমী পরিবর্তনগুলো বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। এখানে বন্যার প্রাকৃতিক কারণগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো
৪.১.১. ভারী ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত
বাংলাদেশের জলবায়ু মূলত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মৌসুমী বৃষ্টিপাত ঘটে। এই সময়টাই দেশের অধিকাংশ বন্যা হয়। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদী, খাল, জলাশয়ের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, এবং যখন সেই পানি নদীর তলদেশ উপচে পড়ে, তখন আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা হয়।
মধ্য এশিয়া থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা বৃষ্টি: বাংলাদেশে সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, চীন, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশ থেকে বৃষ্টি চলে আসে। এই বৃষ্টি ঢাকার পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বেশি পরিমাণে প্রভাব ফেলে, এবং যদি পানি দ্রুত নেমে না যায় বা সঠিকভাবে নিষ্কাশন না হয়, তাহলে বন্যা সৃষ্টি হয়।
৪.১.২. বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় ও উপকূলীয় বন্যা
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং মেঘালয়-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলিতে বন্যা সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, যা জোয়ারের পানি সমুদ্র থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে ঢুকে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক এলাকায় উচ্চজোয়ার এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্যা হয়ে থাকে।
৪.১.৩. নদীর পানি বৃদ্ধি
বাংলাদেশ হচ্ছে একটি নদীপ্রধান দেশ। দেশের প্রধান নদীগুলো হল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গঙ্গা, কুশিয়ারা, সাঙ্গু, করতোয়া ইত্যাদি। এই নদীগুলোর পানির প্রবাহ অনেক সময় অতিরিক্ত হয়ে যায়, বিশেষত যখন একাধিক কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রধান উৎস হল হিমালয় পর্বতমালার উত্তরের অঞ্চল থেকে আসা নদীর পানির প্রবাহ।
হিমালয়ে প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত হয় এবং গ্রীষ্মকালে এই তুষার গলন হয়ে নদীগুলির পানি বৃদ্ধি পায়। এই পানি দেশের মধ্যাঞ্চল ও নিচু এলাকায় এসে জমে যায় এবং অতিরিক্ত পানি উপচে পড়লে বন্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে নদীর বাঁধ তৈরি করা হয়েছে, তবে সেগুলোর গঠন দুর্বল বা অপর্যাপ্ত থাকলে পানি বেড়ে গিয়ে বাঁধ ভেঙে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৪.১.৪. তুষার গলন
উত্তর ভারত এবং হিমালয়ের অঞ্চলে তুষারের গলনও বাংলাদেশের বন্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। গ্রীষ্মকালে তুষারের গলন বৃদ্ধি পেলে নদীর পানির স্তর দ্রুত বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৪.১.৫. বনাঞ্চল ধ্বংস এবং ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন
বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। বনভূমি না থাকলে বৃষ্টিপাতের পর পানি দ্রুত নদী-নালায় চলে যায় এবং নদী উপচে পড়ে। এছাড়া কৃষি জমি, বসতবাড়ি, সড়ক তৈরি করা বা নদী খননের মাধ্যমে প্রকৃতির ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, যা বন্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
৪.১.৬. জলবায়ু পরিবর্তন
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। বাংলাদেশের উপর যে ধরনের মৌসুমী বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব পড়ছে, তা বন্যার পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং প্যাটার্ন পরিবর্তিত হতে পারে, যা বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি করবে।
৪.২. মানবসৃষ্ট কারন বা কৃত্রিম কারন
বাংলাদেশে বন্যা হওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু মানবসৃষ্ট কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবসৃষ্ট কিছু পরিবর্তন এবং কার্যক্রম বন্যার পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে এবং এর প্রকোপ বাড়াতে পারে। এখানে বাংলাদেশের বন্যার মানবসৃষ্ট কারণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
৪.২.১. অতিরিক্ত নগরায়ন এবং নদী দখল
বাংলাদেশে শহরকেন্দ্রিক নগরায়ন দ্রুত বাড়ছে, বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি বড় শহরগুলোর আশপাশে। শহর সম্প্রসারণের ফলে নিম্নাঞ্চল বা নদী তীরবর্তী এলাকার প্রাকৃতিক জল ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এই সব এলাকা নদী এবং জলাশয়গুলোর কাছে অবস্থিত থাকায় তাদের ওপর নির্মাণ করা ভবন, রাস্তা এবং অন্যান্য স্থাপনা নদী বা পানির প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৪.২.২. বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণে ভুল পরিকল্পনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
বাংলাদেশে অনেক নদীর ওপর বাঁধ এবং ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে যাতে করে পানি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু অনেক সময় এই বাঁধ এবং ড্যামের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করা হয় না এবং কিছু বাঁধের ডিজাইন যথেষ্ট শক্তিশালী হয় না। যদি বাঁধ বা ড্যাম ভেঙে যায়, তখন বিপুল পরিমাণ পানি উপচে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে যমুনা নদীর উপর নির্মিত একটি বাঁধ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
৪.২.৩. অতিরিক্ত নদী খনন ও সেচ ব্যবস্থার ভুল ব্যবহার
অনেক সময় নদী বা জলাশয় থেকে অতিরিক্ত বালি বা মাটি উত্তোলন করা হয়, যা নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয়। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং নদী অতি দ্রুত পূর্ণ হয়ে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, অতিরিক্ত সেচ ব্যবস্থার ব্যবহার বিশেষ করে কৃষি কাজে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার—নদীর পানির প্রবাহের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৪.২.৪. বন উজাড় ও ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন
বাংলাদেশে বন উজাড় হওয়া এবং ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। বনাঞ্চল পানি শোষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ বনাঞ্চল বৃষ্টিপাতের পানি জমা হতে দেয় এবং মাটি শোষণ করতে সাহায্য করে। বন উজাড়ের ফলে তা কমে গিয়ে জলাধার সৃষ্টি হয়, এবং পানি দ্রুত নদীতে চলে আসে, যা বন্যার কারণ হয়।
৪.২.৫. ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন
কৃষি জমি থেকে বনভূমি পরিণত করে কৃষিকাজের জন্য জলাধারের সৃষ্টি এবং জলাশয়ের ওপর বিল্ডিং নির্মাণের ফলে পানি জমে গিয়ে বন্যা বৃদ্ধি পায়।
৪.২.৬. অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা
নগর এলাকায় এবং গ্রামীণ অঞ্চলে অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টির পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারে না। সড়ক ও শহরের বিভিন্ন এলাকা ভরা থাকে পানি, যা জমে গিয়ে বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় শহরগুলোর অনেক এলাকায় প্লাবন জলাশয় ও সড়কগুলো সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মিত নয়। এর ফলে বৃষ্টির পানি কোথাও জমে যায় এবং প্লাবিত এলাকার সংখ্যা বাড়ে।
৪.২.৭. নদী শাসন এবং অবৈধ দখল
বাংলাদেশে অনেক অঞ্চলে নদী শাসনের কাজ হয়েছে, তবে অনেক সময় নদী শাসনের কাজ সঠিকভাবে না হওয়া, অতিরিক্ত মাটি তোলা এবং অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা বন্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অনেক জায়গায় নদী বা খাল অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে, এবং সেগুলোতে বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে, যা নদীর প্রবাহে সমস্যা তৈরি করে এবং পানি জমে বন্যা সৃষ্টি হয়।
৫. বাংলাদেশের বন্যা
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে বিশেষ করে বর্ষাকালে বাংলাদেশে বন্যা বেশি হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে বন্যা শুধু প্রাকৃতিক কারণে নয়, মানবসৃষ্ট নানা কারণেও বৃদ্ধি পায়। দেশের ভূগোল, জলবায়ু, নদী ব্যবস্থা এবং নগরায়নের বিভিন্ন ধারা বন্যার প্রকোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ মূলত একটি নদীপ্রধান দেশ।
দেশের ৯০% নদী ভারত, মিয়ানমার, নেপাল বা চীন থেকে এসে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রধান নদীগুলির মধ্যে রয়েছে: পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, সাঙ্গু। এই নদীগুলোর পানি মূলত হিমালয়ের তুষার গলন, মৌসুমী বৃষ্টিপাত, এবং নদীশাসনের ওপর নির্ভর করে। নদীগুলোর পানির স্তর বাড়লে এসব নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকা দ্রুত প্লাবিত হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা নদী অববাহিকায় অবস্থিত, যেগুলি বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। এখানকার জলাভূমি, হাওর, চরে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা সীমিত, ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি বা নদীর পানির চাপ তৈরি হলে এই এলাকা প্লাবিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্তিক গঠন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রতিবছর ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মধ্যে ১৮% বন্যায় কবলিত হয়ে থাকে। এর আগেও বড় বড় বন্যা বাংলাদেশকে ধ্বসং করেছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে বেশি ক্ষতি করেছে। হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়ে ছিল।
৬. বাংলাদেশের বন্যার ইতিহাস
বাংলাদেশের বন্যার ইতিহাস অত্যান্ত দীর্ঘ এবং বৃহৎ। বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ হওয়ার ফলে এই দেশের মানুষকে প্রতিবছরই বন্যার কবলে পড়তে হয়। নিচে বাংলাদেশের বন্যার ইতিহাস বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও বছর অনুযায়ী পয়েন্ট আকারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
৬.১. ১৮৭৬ সালের বন্যা (১৯শতকের মাঝামাঝি)
১৮৭৬ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বড় ধরনের বন্যা ঘটে। এই বন্যা শুধু নদী প্লাবন নয়, বরং খাল-বিলও উপচে পড়েছিল। এ সময়ের বন্যার কারণে অনেক এলাকায় জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল, এবং হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
৬.২. ১৯৪৭ সালের বন্যা (বিভাজন পরবর্তী)
দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে আরও একটি বড় বন্যার ঘটনা ঘটে। সেসময় পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশ হিসেবে নতুনভাবে বিভক্ত হলেও, প্রবাহিত নদীগুলোর উপর সীমানা ভাগের ফলে বন্যার তীব্রতা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে।
৬.৩. ১৯৫৪ সালের বন্যা
১৯৫৪ সালের ২০ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
৬.৪. ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এবং বন্যা
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সংকট ঘটে। এই বন্যা খাদ্য সরবরাহ চেইনকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে ২ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলে।
৬.৫. ১৯৮৮ সালের বন্যা
১৯৮৮ সালের ২৭ জুলাই থেকে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম বন্যা হিসেবে চিহ্নিত। দেশের ৬০টি জেলার ২০ হাজারেরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। প্রায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, এবং প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছিল।
এ বছর বন্যার কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৫,০০,০০০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বন্যার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
৬.৬. ১৯৯৮ সালের বন্যা
১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল আরও একটি মহামারী, যা ৪ মাস ধরে চলেছিল (জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত)।পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদনে জানা যায় যে প্রায় ৬০% বাংলাদেশের ভূমি প্লাবিত হয়েছিল। প্রায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় এবং ৩ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষি জমি, সড়ক ও ব্রিজের কারণে প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
৬.৭. ২০০৪ সালের বন্যা
২০০৪ সালের জুলাই থেকে আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা ঘটে। অধিকাংশ নদী তীরবর্তী ৫৫টি জেলার মধ্যে ৩০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। প্রায় ১০ লাখ একর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা খাদ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৬.৮. ২০১৪ সালের বন্যা
২০১৪ সালের জুন থেকে জুলাই মাসে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের অনেক এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়। জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, খুলনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে বন্যার তীব্রতা দেখা যায়। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়।
৬.৯. ২০২০ সালের বন্যা
২০২০ সালে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে একাধিক পর্যায়ে বন্যা হয়েছিল। দেশের ৪০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়।বন্যার কারণে খাদ্য সরবরাহের সমস্যা তৈরি হয় এবং কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়। প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয় এবং লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারায়।
৬.১০. ২০২৪ সালের বন্যা
২০২৪ সালের বন্যা পরিস্থিতি এখনও চলমান, এবং এটি মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে একটি বড় বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে এবং এটি আরো দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।
বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস বহু পুরনো এবং এটি একটি অবিচ্ছেদ্য দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে প্রতি বছর নদীগুলোর অতিরিক্ত পানি ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা সৃষ্টি হয়, এবং কখনো কখনো এই বন্যাগুলি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০১৪, ২০২০ সালসহ বেশ কিছু বছর বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার কারণে বিশাল ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত নগরায়ন, বনভূমি ধ্বংস, এবং অপ্রতুল নদী শাসন বন্যার প্রকোপ বাড়ানোর প্রধান কারণ।
৭. বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে বেশি বন্যা হয়
বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ বিশেষ কিছু অঞ্চলে বেশি দেখা যায়, যেগুলো সাধারণত নদী তীরবর্তী, নিম্নভূমি, অথবা বৃষ্টিপাত বেশি হয় এমন এলাকা। নিচে পয়েন্ট আকারে বাংলাদেশে বন্যা বেশি হয় এমন অঞ্চলের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
- কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন অংশ মেঘনা নদী এবং তার শাখানদীগুলোর জন্য বিপজ্জনক হয়ে থাকে। এখানে বন্যা বেশিরভাগ সুনামগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত হয়, যেখানে হাওরের পানি অতিরিক্ত জমে গিয়ে বৃহত্তর বন্যার সৃষ্টি হয়।
- সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা: হাওর অঞ্চলগুলো নদী এবং জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং এখানে বন্যা হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশেষত সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার হাওর এলাকার পানি দ্রুত বেড়ে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে। এ অঞ্চলের মানুষ বর্ষাকালে বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
- চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার: বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থান ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এই অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস এবং ভারী বৃষ্টি বন্যার সৃষ্টি করে।চট্টগ্রাম শহরের সন্নিকটে থাকা নদীগুলোর পানি অতিরিক্ত হয়ে শহর প্লাবিত হতে পারে। কক্সবাজারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীর পানি বাড়ায় এই অঞ্চলে বন্যা এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
- পূর্বাঞ্চল (মেঘনা অববাহিকা) ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ: মেঘনা এবং তার শাখানদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলগুলোতে বন্যা হয়। মেঘনা নদী এবং ধলাই নদী বিশেষভাবে পূর্ণ হয়ে প্লাবন সৃষ্টি করতে পারে। এই অঞ্চলের খাল-বিল ও জলাভূমি, বিশেষ করে হাওর এলাকায় বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়।
- রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা: পদ্মা,গঙ্গা, যমুনা এবং তাদের শাখানদীগুলোতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হলে এই অঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়।এই এলাকাগুলোর নদীগুলোর পানি সহজেই বিপদসীমার উপর চলে যায়, যা বন্যা সৃষ্টি করে।রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার নিচু জমিতে বছরের পর বছর বন্যার সমস্যা দেখা যায়।
- খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা: এই অঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমি সমুদ্রতলের নিচে, তাই জলোচ্ছ্বাস,ঘূর্ণিঝড় এবং উপকূলীয় নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি বন্যার সৃষ্টি করে।বরগুনা, পটুয়াখালী এবং সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা ও জলাবদ্ধতা সবচেয়ে বেশি হয়, বিশেষত বঙ্গোপসাগর থেকে আসা অতিরিক্ত পানি। এই অঞ্চলে প্রতিবারের ঘূর্ণিঝড়ের পর পানির স্তর বৃদ্ধি পায় এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়ে।
- বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর: বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়া এবং নদীগুলোর প্রবাহের ফলে বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর অঞ্চলগুলোও বন্যার কবলে পড়ে। বরিশালের বেশিরভাগ অংশ সমুদ্রতলের নিচে, ফলে উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের কারণে এখানকার প্লাবন প্রবণতা বাড়ে।
৮. বাংলাদেশে বন্যার কারণ
বাংলাদেশে বন্যার নানা ধরনের কারণ রয়েছে, যা প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় ধরনের হতে পারে। বাংলাদেশে বন্যা বেশিরভাগ সময় ঘটে বর্ষা মৌসুমে, তবে এর পেছনে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। নিচে বাংলাদেশের বন্যার কারণগুলো পয়েন্ট আকারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
৮.১. ভারী বর্ষণ
বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বন্যার প্রধান কারণ।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে প্রচুর বৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত নদীগুলোর পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং নদী তীরবর্তী নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়।
৮.২. নদী অববাহিকার পানির স্তরের বৃদ্ধি
নদীর পানি অতিরিক্ত বেড়ে গেলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা ঘটে।বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলির মধ্যে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং মেঘনা নদী রয়েছে। এই নদীগুলোর পানি তীব্র বর্ষণ বা হিমালয়ের তুষার গলনের কারণে নদী পানি উপচে পড়ে এবং প্লাবন সৃষ্টি হয়।
ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে তুষার গলন এবং ভারী বর্ষণের কারণে নদীতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হলে এটি বাংলাদেশের নদী অববাহিকার পানি স্তর বাড়িয়ে দেয় এবং বন্যার সৃষ্টি হয়।
৮.৩. নদী দখল ও ভরাট
নদী দখল এবং ভরাটের কারণে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে বন্যার প্রকোপ বাড়ে। অনেক স্থানে অবৈধভাবে নদী দখল ও ভরাটের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। নদীশাসন সঠিকভাবে না হওয়ায় নদী ও খালের পানি বের হতে পারে না, যা প্লাবন সৃষ্টি করে। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকার বসতি এবং কৃষি জমিতে বন্যার ক্ষতি হয়।
৮.৪. সেচ ব্যবস্থা
সেচ ব্যবস্থার কারণে পানি ব্যবহারের অতিরিক্ত চাপ এবং পানির স্তর বৃদ্ধি পায়। নদী ও জলাশয় থেকে অতিরিক্ত পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা কখনো কখনো নদী বা জলাশয়ের পানি প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষত নদীর উপরের অংশে সেচের কারণে নদীর পানি ছড়িয়ে পড়লে নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়।
৮.৫. বাঁধ এবং ড্যাম
বাঁধ এবং ড্যাম দুর্বল বা ভেঙে যাওয়ার কারণে বন্যা ঘটে। দেশের বিভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ করা হয়। তবে বাঁধের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করলে বা অতিরিক্ত পানির চাপের কারণে বাঁধ ভেঙে গেলে বড় ধরনের বন্যা ঘটে। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় বাঁধ ভেঙে ব্যাপক বন্যা হয়েছিল।
৮.৬. ভূমির শোষণ ক্ষমতার হ্রাস
ভূমির শোষণ ক্ষমতা কমে গেলে বৃষ্টির পানি সঠিকভাবে মাটির ভেতর প্রবাহিত হতে পারে না। বন উজাড় এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে মাটি ও ভূমির শোষণ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি সহজেই মাটির গভীরে প্রবাহিত না হয়ে নদী বা সড়ক দিয়ে দ্রুত চলে আসে, যার ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভূমি ক্ষয় এবং জলাশয় ভরাটের কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে যায়, যা বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
৮.৭. ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোন
বঙ্গোপসাগর থেকে আগত ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় বন্যা ঘটে। ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, বিশেষত বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা এলাকায়। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলাবদ্ধতা এবং তীব্র বৃষ্টিপাত সেসব অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে।
৮.৮. জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন এবং পরিমাণ পরিবর্তন ঘটে, যা বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে এবং যার ফলে প্রবল বৃষ্টি হয়। এর ফলে নদীগুলোর পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যায় এবং বন্যার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়ে।
৮.৯. জলাশয় ও হাওরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন
জলাশয় ও হাওরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন বা ভরাট হওয়ার ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। হাওর এবং জলাশয় গুলি প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ধারণ করে। তবে মানবসৃষ্ট কারণে এসব জলাশয় ভরাট হয়ে গেলে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে যায় এবং বন্যার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ইত্যাদি অঞ্চলে হাওরের পানির স্তরের দ্রুত বাড়তে থাকে, যার ফলে দ্রুত বন্যা দেখা যায়।
৮.১০. বন উজাড়
বন উজাড়ের কারণে ভূমির শোষণ ক্ষমতা কমে যায়। বনাঞ্চল পানি শোষণ করে এবং প্রাকৃতিক বাধার মতো কাজ করে। তবে বন উজাড়ের কারণে ভূমির শোষণ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত নদীতে চলে আসে এবং বন্যা সৃষ্টি হয়। এ কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা বেশি হয়।
৮.১১. নগরায়ন এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তন
অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং নগরায়নের কারণে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়, যা বন্যার কারণ হতে পারে। শহরের উন্নয়ন এবং বসতবাড়ি নির্মাণের ফলে নদী বা খালগুলোর উপর অবকাঠামো তৈরি হয় এবং এগুলোর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে করে পানির স্তর বাড়ে এবং বন্যা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং অন্যান্য শহরের উচ্চতর নগরায়নের ফলে বন্যা হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব
বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যা শুধুমাত্র পরিবেশ এবং প্রকৃতির ওপরই নয় বরং মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নিচে বাংলাদেশের বন্যার প্রভাবগুলো পয়েন্ট আকারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
৯.১. মানুষের জীবন ও মৃত্যু
বন্যার কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাস, বৃষ্টি এবং ভূমিধস হয়ে মারা যায় বহু মানুষ। বন্যার কারণে লাখ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয় অথবা অস্থায়ী শিবিরে বাস করতে বাধ্য হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে বন্যার প্রভাব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার ফলে উদ্বেগ, দুঃখ, হতাশা এবং পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগের বিস্তার ঘটে।
৯.২. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব
বন্যার কারণে জমির ফসল পানিতে ডুবে যায়, যার ফলে বড় আকারে ফসল নষ্ট হয়। ধান, শাকসবজি, গম এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য তলিয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ফসলের ক্ষতির কারণে খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে এবং খাদ্যের অভাব তৈরি হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যার সৃষ্টি করে। বন্যার কারণে কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা এবং সেচকূপের উপকরণ পানির নিচে ডুবে যায়, যার ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৯.৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি
কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত, এবং বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর ফলে দেশের কৃষি অর্থনীতির বড় ধরনের সংকট দেখা দেয়। সড়ক, ব্রিজ, বাঁধ, জলাধার, স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। দোকানপাট, ক্ষুদ্র ব্যবসা, বাজার ও কলকারখানা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
৯.৪. পরিবেশগত প্রভাব
বন্যার কারণে মাটি ও জলাশয়ের গুণগত মান কমে যায় এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়। বন্যার পানির কারণে নদী, খাল এবং জলাশয়ে মানবসৃষ্ট বর্জ্য, পলিথিন এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ প্রবাহিত হয়ে পরিবেশের অবস্থা খারাপ করে ফেলে। বন্যার ফলে বনভূমি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং অরণ্যাঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণীজগতের ক্ষতি হয়। এতে করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
৯.৫. স্বাস্থ্যগত সমস্যা
বন্যার পানি দ্বারা পরিবেশে জলবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বন্যার কারণে পঁচা পানি ব্যবহারের ফলে স্যানিটেশন পরিস্থিতি খারাপ হয়, যার কারণে জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় দেখা দেয়। বন্যার কারণে গর্ভবতী মায়েরা, শিশু এবং বৃদ্ধরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে নিশ্চিত না করতে পারলে মৃত্যুর হার বাড়ে।
৯.৬. যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো ক্ষতি
বন্যার কারণে সড়ক, সেতু ও ব্রিজ পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে, যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সেবা বন্ধ হয়ে যায়। সেচ, পাম্প এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তলিয়ে যাওয়ার ফলে পয়ঃনিষ্কাশন এবং পানি সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়।
৯.৭. শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উপর প্রভাব
বন্যার কারণে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়, যা ভবিষ্যতে তাদের চাকরি ও জীবনমানের ওপর প্রভাব ফেলে। বই, শিক্ষা উপকরণ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাজীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
৯.৮. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি
বন্যার কারণে বহু পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে তাদের সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব পড়ে। বহু ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা, মন্দির, মসজিদ, স্কুল, গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য স্থাপনাও বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।
৯.৯. বন্যার পর পুনরুদ্ধার খরচ
বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। পুনরুদ্ধারে ভূমি উন্নয়ন, বাড়িঘর পূণরায় নির্মান, এবং কৃষি পুনরুদ্ধারের জন্য খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়। বড় ধরনের বন্যার ফলে সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং ত্রাণ বিতরণে বিশাল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়।
৯.১০. অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ও শরণার্থী সংকট
বন্যার কারণে হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে দিশে হারা হয়ে যায়। এতে নতুন আশ্রয় খুঁজে নেয়ার জন্য মানুষকে অন্য অঞ্চলে যেতে হয়। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী অঞ্চল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বন্যার কারণে অন্যত্র চলে যায়, যা শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করে।
১০. বাংলাদেশে বন্যা সমস্যার প্রতিকার
বাংলাদেশে বন্যা একটি নিয়মিত সমস্যা এবং এর কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয় প্রতিটি সেক্টরে যেমন কৃষি, মানব জীবন, অর্থনীতি, পরিবেশ ইত্যাদি। তবে, বন্যার সমস্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বন্যা প্রতিরোধের জন্য সম্ভাব্য কিছু প্রতিকার ও ব্যবস্থা নিম্নে পয়েন্ট আকারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১০.১. নদী শাসন ও জলধারার উন্নয়ন সাধন
নদী ও নদীর তীরের সঠিক শাসন কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি। নদী খনন, ড্রেজিং, নদী তীর সংরক্ষণ এবং নদী প্রবাহের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। নদী, খাল, জলাধার এবং বাঁধগুলো সঠিকভাবে নির্মাণ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে যাতে নদীর পানি স্থিতিশীল থাকে এবং বাঁধ ভাঙার ঝুঁকি কমে।
বিভিন্ন স্থানে জলাধার ও ড্যাম নির্মাণ করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি ধারণ করা যায় এবং তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহ কমানো যায়।
১০.১. সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ
সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত সেচের ফলে নদীর পানি স্তর বৃদ্ধি না পায়। পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করে সেচ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকরী এবং পরিবেশবান্ধব করতে হবে, যেমন পানি সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির পানি জমা করার ব্যবস্থা।
১০.২. পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা
আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বৃষ্টি ও নদীর পানি প্রবাহের পূর্বাভাস নিশ্চিত করতে হবে যাতে বন্যার আগাম সতর্কতা পাওয়া যায় এবং সঠিক সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি নেয়া যায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, পুকুর, খাল ও জলাশয়গুলোর পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে যাতে পানি সঠিকভাবে বিতরণ ও প্রবাহিত হয়।
১০.৩. বাঁধ ও বাধা সিস্টেম শক্তিশালী করা
পুরানো বাঁধগুলো মেরামত ও পুনঃনির্মাণ করতে হবে এবং বাঁধের শক্তি বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। নদীর তীরের জন্য রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করতে হবে যাতে নদীর পানি বাড়লে তা তীরের উপরে না উঠে যায়।
১০.৪. বনসংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ
বনভূমি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, কারণ বনাঞ্চল পানি শোষণ করে এবং ভূমি ক্ষয় রোধ করে। গাছের সংখ্যা বাড়িয়ে মাটির শোষণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে যাতে ভূমিধস ও বন্যার প্রবণতা কমে। নদী ও পাহাড়ের পাশে গাছ লাগিয়ে ভূমি ক্ষয় এবং বন্যার তীব্রতা কমানো সম্ভব।
১০.৫. শহর ও গ্রামাঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন
রে এবং সড়ক ও আবাসিক এলাকা প্লাবিত না হয়। শহরের পানি নিস্কাশনের জন্য কার্যকরী ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত বের হয়ে যায়।
১০.৬. ভাটি অঞ্চলে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি
হাওর ও জলাভূমির ধারণক্ষমতা বাড়াতে এবং তাদের জলাধারের ক্ষমতা উন্নত করতে হবে যাতে বর্ষার অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হলে নদীর পাড়ে জমে থাকা অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করা উচিত।
১০.৭. মানুষকে সচেতন করা
জনগণকে বন্যার পূর্বাভাস, প্রস্তুতি এবং বন্যার পরবর্তী পুনর্বাসন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। জনগণকে বন্যা প্রতিরোধে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে জানানো উচিত, যেমন বৃষ্টির পানি সংগ্রহের প্রযুক্তি এবং সাশ্রয়ী নির্মাণ পদ্ধতি। বিভিন্ন গ্রাম ও অঞ্চলে কমিউনিটি ভিত্তিক বন্যা প্রস্তুতি কার্যক্রম গড়ে তোলা।
১০.৮. বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা
স্যাটেলাইট ইমেজ, রাডার এবং আধুনিক আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা ব্যবহার করে বন্যার পূর্বাভাস প্রদান করতে হবে। লোকজনকে দ্রুত সতর্ক করতে মোবাইল অ্যাপ, টেলিভিশন ও রেডিও মাধ্যমে আগাম সতর্কতা দেওয়া উচিত।
১০.৯. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন
বন্যার সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে, যা অন্তর্ভুক্ত করবে আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি। বন্যার পর দ্রুত পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সিডিএমএ (কমিউনিটি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করলে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে। বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০.১০. উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার
বন্যার কবল থেকে কৃষি রক্ষা করতে বন্যা সহিষ্ণু ফসলের চাষ বাড়ানো উচিত, যেমন ধান ও অন্যান্য শস্যের জাত যাতে পানিতে তলিয়ে যাওয়া থেকে কম ক্ষতি হয়। ফসল সুরক্ষিত রাখতে ফসলের আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে, যাতে জলাবদ্ধতা হলে ফসল তলিয়ে না যায়।
১০.১১. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
বাংলাদেশে বন্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও তহবিল গ্রহণ করা উচিত, যাতে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম কার্যকর হয়। অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে প্রযুক্তি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা উচিত।
১১. বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে, বন্যা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও সরকার কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বন্যার তীব্রতা এবং তার প্রভাব অনেকটা কমাতে সক্ষম হয়েছে।
নিচে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য পয়েন্ট আকারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১১.১. বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ
দেশব্যাপী বাঁধ ও তীর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে সারা দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বাঁধের মাধ্যমে এমন জলমগ্ন অঞ্চলে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের বসবাসের জায়গাগুলো নিরাপদ করা হয়েছে।
১১.২. নদী শাসন ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন
নদী ও খালের সঠিক শাসন এবং খনন কার্যক্রমের মাধ্যমে পানি প্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রধান নদী যেমন পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী শাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নদী ও খালের মজুদ ফেলা বা তলিয়ে যাওয়া অংশে ড্রেজিং এবং খনন কার্যক্রম চলছে, যার মাধ্যমে নদী ও খালের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং পানি প্রবাহ সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। পানি সংরক্ষণ এবং বন্যার পানি পরিচালনার জন্য নতুন জলাধার, বাঁধ এবং পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।
১১.৩. বন্যা সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ
বন্যার সময় সহায়ক আবাসস্থল তৈরি করা এবং ফ্লাডপ্রুফ ঘর নির্মাণের জন্য নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বন্যার পরবর্তী সময়ে গঠনমূলক পুনর্বাসন এবং অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
১১.৪. বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা
সরকার বন্যার পূর্বাভাস এবং সতর্কতার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বিশেষত, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (ইডউই) বন্যার পূর্বাভাস প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে।
বন্যার পূর্বাভাস এবং সতর্কতা সংকেত নির্ধারণের জন্য দেশব্যাপী একাধিক সতর্কতা নেটওয়ার্ক এবং সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জনগণ আগাম সতর্ক হতে পারে। মানুষের কাছে বন্যা সম্পর্কিত তথ্য দ্রুত পৌঁছানোর জন্য বিশেষ অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সঠিক সময়ে বন্যার পূর্বাভাস পেতে সক্ষম হচ্ছে।
১১.৫. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা
বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বন্যার সময় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণ, খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, আশ্রয়কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় এনজিও এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে, যাতে মানুষের জীবন রক্ষা হয়।
১১.৬. বন্যা প্রতিরোধে গবেষণা ও প্রযুক্তি ব্যবহার
সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যেমন, স্যাটেলাইট ইমেজিং, ড্রোন প্রযুক্তি, এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা যাতে বন্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কৃষি খাতে বন্যা সহিষ্ণু ফসল চাষে সরকারের সহযোগিতা এবং গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকদের বন্যার ক্ষতি কমানো হয়েছে।
১১.৭. মাটি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা
সরকার ভূমি ক্ষয় রোধে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যেমন নদী তীরবর্তী অঞ্চলে উপকূলীয় বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং নদীর তীরের সুরক্ষা। সরকার নদী তীর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে গাছপালা এবং বনাঞ্চল বাড়ানোর জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালু করেছে, যা ভূমি ক্ষয় এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
১১.৮. জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বন্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের জন্য বন্যা প্রস্তুতির উপর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে তারা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে।
১১.৯. জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা
বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, যা দুর্যোগের পূর্বে এবং পরবর্তী সময়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যা দুর্গত এলাকায় জরুরি পরিসেবা যেমন চিকিৎসা সেবা, পানি সরবরাহ, খাদ্য বিতরণ এবং আশ্রয় সেবা নিশ্চিত করা হয়।
১১.১০. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের বন্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশগুলির সাহায্য গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিভিন্ন তহবিলের মাধ্যমে বন্যা পুনর্বাসন ও দুর্যোগ সুরক্ষা কার্যক্রমের জন্য অর্থায়ন করা হচ্ছে।
১২. বন্যার পরবর্তী পুনর্বাসন
বন্যার পরবর্তী পুনর্বাসন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি প্রক্রিয়া, যা ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। বন্যার ফলে আক্রান্ত অঞ্চলে মানুষের বসবাস, স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক কার্যক্রম প্রায় একেবারে থেমে যেতে পারে।
তাই, সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো হয়। এটি শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং সুস্থ জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয়। নিচে বন্যার পরবর্তী পুনর্বাসন সম্পর্কে আলোচনা করা হল :-
১২.১. ত্রাণ বিতরণ
বন্যার পর প্রথম দিকের পুনর্বাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জন্য ত্রাণ হিসেবে চাল, ডাল, তেল, লবণ, খাবার পানি এবং অন্যান্য প্রাথমিক খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা হয়।
পানি নিষ্কাশন এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার অবস্থা খারাপ হলে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ এবং স্যানিটারি উপকরণ যেমন সাবান, টয়লেট পেপার, প্যাড, পিপিআই প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্য পরিসেবা নিশ্চিত করতে, চিকিৎসক দল প্রেরণ করা হয় এবং বন্যার পর পানিবাহিত রোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে টিকা দেওয়া হয়।
১২.২. আশ্রয় ব্যবস্থাপনা
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে অস্থায়ী শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়। এই শিবিরগুলোতে টেন্ট, বেড, চাদর, এবং অন্যান্য মৌলিক জীবনযাপনের উপকরণ সরবরাহ করা হয়। যারা নিজেদের বাড়ি হারিয়েছে তাদের জন্য সরকার বা বিভিন্ন মানবিক সংস্থা পূনরায় বাড়ি নির্মাণ বা মেরামতের উদ্যোগ নেয়।
এই প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বা কাঠের ঘর বা ছোটো ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা আবার বসবাস করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্তরা এলাকার মানুষদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নতুন আবাসন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়, বিশেষ করে যারা গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
১২.৩. কৃষি পুনর্গঠন
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের জন্য সরকার বা সাহায্যকারী সংস্থাগুলো বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণ করে যাতে তারা দ্রুত নতুন ফসল চাষ শুরু করতে পারে। বন্যার পানি জমির উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্থ জমির জন্য সেচ ব্যবস্থা মেরামত বা ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করা হয় যাতে ফসলের ক্ষতি কমানো যায়। কৃষকদের প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ফসল পুনঃতৈরি করতে সহায়তা করা হয়, যাতে তারা দ্রুত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
১২.৪. অর্থনৈতিক পুনর্বাসন
বন্যার পর কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা হয় যেমন রাস্তা সংস্কার, অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ এবং পুনর্গঠন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা উপার্জন করতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনঃস্থাপন এবং তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করার জন্য ঋণ দেয়া হয়।
বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্থ দোকান, মার্কেট, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পুনঃঅর্থায়ন করা হয়। ক্ষতিগ্রস্থ শিল্প, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকার সহায়তা দেয় যাতে তারা আবার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। ব্যবসায়িক ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
১২.৫. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পুনর্বাসন
বন্যার পর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোর পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করা হয়, যাতে মানুষ সেবা পেতে পারে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা দুর্গতদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। জলবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করতে টিকা প্রদান ও স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতায় বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালানো হয়। বন্যার পর মানসিক চাপ, উদ্বেগ, দুঃখ, এবং আতঙ্কের পরিমাণ বাড়ে। এই কারণে মানসিক সহায়তা প্রদান করা হয়, যেখানে কাউন্সেলিং ও থেরাপির মাধ্যমে মানুষকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখা হয়।
১২.৬. শিক্ষা পুনর্বাসন
বন্যার ফলে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেগুলোর পূণরায় নির্মাণ ও মেরামত করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা আবার পড়াশোনা শুরু করতে পারে। ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান শুরু করার জন্য শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত হন এবং শারীরিক, মানসিক, এবং সামাজিক দিক থেকে শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর সন্তানদের জন্য বৃত্তি বা শিক্ষা উপকরণ প্রদান করা হয়, যাতে তারা শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে পারে। বিনামূল্যে বই এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়।
১৩. উপসংহার
বাংলাদেশে বন্যা একটি পুনঃক্রমিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জীবনযাত্রা, কৃষি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান, নদ-নদীর ব্যাপকতা, অস্বাভাবিক আবহাওয়া পরিবর্তন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণের জন্য বন্যার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
তবে বন্যা প্রতিকার ও মোকাবেলায় সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক সহায়তা, এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা পূর্বাভাস সিস্টেম, বাঁধ নির্মাণ, কৃষি পুনর্বাসন, এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। উপরোক্ত পোস্টে একজন পাঠক বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাবে।
"বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা ২০ পয়েন্ট" কন্টেন্টটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মন্তব্য করুন। আপনার ফিডব্যাক আমাদের আরও উন্নত কন্টেন্ট তৈরিতে সহায়ক হবে! 📝💬
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url