রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দোয়া ও আমলসমূহ
রমজান মাস হল রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস, যেখানে মুসলমানরা আল্লাহর অশেষ রহমত, গুনাহ মাফ এবং দোজখ থেকে মুক্তির সুযোগ লাভ করে। এই পবিত্র মাসে বিশেষ কিছু দোয়া ও আমল রয়েছে, যা পালন করলে আল্লাহর রহমত অর্জন, গুনাহ মাফ এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি লাভ করা সম্ভব।এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান, তাই বেশি বেশি দোয়া, ইবাদত ও নেক আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উচিত।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দোয়া ও আমলসমূহ" সম্পর্কে বিস্তারিত।
ভূমিকা
রমজান হলো মুসলমানদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতের মাস, যেখানে প্রতিটি মুমিনের জন্য আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ আসে। এই মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত। রমজানের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক দোজখ থেকে মুক্তির বা নাজাতের।
এই তিনটি পর্বে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য অশেষ করুণা বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন এবং দোজখ থেকে মুক্তির সুসংবাদ দেন। এই বরকতময় মাসে বেশি বেশি দোয়া ও আমল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "রমজানের প্রথম অংশে আল্লাহর রহমত, মাঝের অংশে মাগফিরাত এবং শেষ অংশে দোজখ থেকে মুক্তি রয়েছে।"
তাই এই মাসের প্রতিটি দিনই ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সেরা সময়। এই লেখায় আমরা রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বিশেষ দোয়া ও আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা সবাই এই মাসের বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে পারি।
আত্মশুদ্ধির মাস রমজান
রমজান মাস আত্মশুদ্ধির এক মহৎ সময়। আত্মশুদ্ধি অর্থ ‘তাযকিয়াতুন নুফুস’, যা ব্যক্তি চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি এটা সম্ভব না হয়, তবে জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।" (সহিহ মুসলিম-১০২, বোখারি-৫০)।
রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, "রমজান সংযমের মাস এবং সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।" (মিশকাত)। অর্থাৎ, এ মাসে সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
রোজার উদ্দেশ্য ও তাকওয়া অর্জন
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।" (সূরা বাকারা: ১৮৩)।
রমজান মাসে মানুষের কথা, আচরণ, লেনদেন ও কাজ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা, প্রতারণা ও অন্যায় কাজ পরিহার করে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।" (সহিহ বোখারি: ১৯০৩)।
রমজানের তিন দশক: রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত
রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস, যেখানে মুমিন মুসলমানরা রোজা, ইবাদত-বন্দেগি ও কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। এ মাসকে মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে—
- রহমত (দয়া),
- মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং
- নাজাত (জাহান্নাম থেকে মুক্তি)।
প্রতিটি দশকের আলাদা ফজিলত ও বিশেষত্ব রয়েছে, যা রোজাদারদের আত্মশুদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির পথ তৈরি করে।
🔹 রমজানের প্রথম দশ দিন: রহমতের দশক
রমজানের প্রথম ১০ দিনকে রহমতের সময় বলা হয়। এই সময়ে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অফুরন্ত দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। রহমতের অর্থ হলো করুণা বা দয়া, যা আল্লাহর অন্যতম গুণ। রমজানের এই প্রথম অংশে আল্লাহ বান্দাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন এবং অসংখ্য রহমত বর্ষণ করেন।
রমজানের প্রথম দশ দিন রহমতের গুরুত্ব
আল্লাহর বিশেষ দয়া ও করুণা
রমজানের প্রথম দশ দিনে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন। যারা এই সময়ে ইবাদত করে, তারা বিশেষ নেকি লাভ করে।
গোনাহ মাফের সহজ সুযোগ
এই দশ দিনে যারা আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তাদের গুনাহ ক্ষমা করেন। হাদিসে এসেছে, "যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।" (সহিহ বুখারি: ৩৮, সহিহ মুসলিম: ৭৬০)
রোজাদারের জন্য জান্নাতের বিশেষ দরজা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা রয়েছে, যেখান দিয়ে কেবলমাত্র রোজাদারগণ প্রবেশ করবে।" (সহিহ বুখারি: ১৮৯৬, সহিহ মুসলিম: ১১৫২)
দোয়া কবুল হওয়ার সময়
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না— রোজাদারের দোয়া, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া এবং মজলুমের দোয়া।" (তিরমিজি: ২৫২৬)
শয়তানের প্রভাব হ্রাস
হাদিসে এসেছে, "রমজানের প্রথম রাতে শয়তান ও অবাধ্য জিনগুলোকে বন্দি করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়।" (তিরমিজি: ৬৮২)
রমজানের রহমতের ১০ দিনের দোয়া ও আমল
রমজানের প্রথম দশ দিনে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। এই সময় যারা একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করে, তাদের জন্য অশেষ রহমত ও বরকতের দ্বার খুলে যায়।
রমজানের রহমতের ১০ দিনের বিশেষ দোয়া
রমজানের প্রথম ১০ দিনে আল্লাহর রহমত কামনা করে বেশি বেশি দোয়া করা সুন্নত। কুরআনে এমন অনেক দোয়া রয়েছে যা রহমত লাভের জন্য পাঠ করা যেতে পারে।
১. রহমত লাভের জন্য কুরআনে বর্ণিত দোয়া
📖 সূরা মুমিনুন, আয়াত ১১৮
- উচ্চারণ: ‘ওয়া কুর রব্বিগফির ওয়ার হাম ওয়া আনতা খইরুর র-হিমীন।’
- অর্থ: "আর বলুন, হে আমার রব! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।"
২. রহমতের জন্য আরও একটি দোয়া
📖 সূরা কাহফ, আয়াত ১০
- উচ্চারণ: ‘রব্বানা আ-তিনা মিল্লাদুনকা রহমাহ, ওয়াহায়্যি’লানা মিন আমরিনা রশাদা।’
- অর্থ: "হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাদের অনুগ্রহ দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন।"
রমজানের রহমতের ১০ দিনে করণীয় আমল
এই ১০ দিনে যত বেশি সম্ভব ইবাদত করা উচিত। বিশেষ করে নিচের আমলগুলো বেশি বেশি করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত—
- আল্লাহর রহমত চেয়ে বেশি বেশি দোয়া করাঃ রমজানের প্রথম দশক রহমতের, তাই এই সময়ে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ কামনা করে বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। উপরোক্ত কুরআনিক দোয়াগুলো ছাড়াও যেকোনো ভালো দোয়া করা যেতে পারে।
- তাওবা ও ইস্তিগফার করাঃ রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। এই সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই বেশি বেশি “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলা উচিত।
- কুরআন তেলাওয়াত করাঃ রমজান কুরআন নাজিলের মাস। এ মাসে কুরআন পাঠ করলে আল্লাহ বেশি সওয়াব দান করেন। তাই প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় কুরআন পড়া উচিত।
- তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজ আদায় করাঃ রাতের শেষ ভাগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলে রহমত লাভের সুযোগ বাড়ে। এ সময় দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- দান-সদকা করাঃ আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম উপায় হলো দান-সদকা করা। গরীব-অসহায়দের সাহায্য করলে আল্লাহ তাআলা রহমত বর্ষণ করেন।
🔹 রমজানের দ্বিতীয় দশ দিন: মাগফিরাতের দশক (ক্ষমার সময়)
রমজানের মধ্যবর্তী ১০ দিনকে মাগফিরাতের সময় বলা হয়। মাগফিরাত অর্থ ক্ষমা। এই সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন, যদি তারা সত্যিকারের অনুশোচনার সাথে তাঁর কাছে ক্ষমা চান। এই দশক হলো আত্মশুদ্ধির সময়, যেখানে বান্দারা নিজেদের ভুল-ত্রুটি শোধরানোর সুযোগ পান।
রমজানের মাগফিরাতের গুরুত্ব
✅ এটি গুনাহ মোচনের শ্রেষ্ঠ সময়।
✅ যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব পাপ ক্ষমা করে দেন।
✅ রমজানের এই সময়ে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা উচিত, যাতে আল্লাহ আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করেন।
✅ অতীত জীবনের পাপ থেকে মুক্তির সুযোগ পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতে সৎ পথে চলার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
"রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমতের, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত লাভের এবং তৃতীয় ১০ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের।" (মিশকাত)
রমজান মাসে আল্লাহর করুণা ও রহমত যেমন বর্ষিত হয়, তেমনি বান্দাদের গুনাহ মাফ করে দেওয়ার জন্যও বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। এই সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন,
"তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং আমার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করে থাকো, তাহলে আমিও সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব।" (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৪০)
এ দশকে বান্দারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের পাপ মোচনের সুযোগ পান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
"সকল মানুষ ভুলকারী। আর ভুলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো যারা তওবাকারী।" (বায়হাকি)
রমজানের মাগফিরাতের দোয়া ও আমল
১. ইস্তেগফার ও তওবা করা
এই দশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে ইস্তেগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে,
"যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করবে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে; সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু পাবে।" (সুরা নিসা: আয়াত ১১০)
মাগফিরাতের বিশেষ দোয়া-
- উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা'ফু আন্নি।
- অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিজি)
২. কুরআন তিলাওয়াত বৃদ্ধি করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"কোরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তোমরা কোরআন তিলাওয়াত কর, কারণ কিয়ামতের দিন কোরআন পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে।" (সহিহ মুসলিম)
৩. বেশি বেশি দান-সদকা করা
দান ও সদকা গুনাহ মোচনের অন্যতম মাধ্যম। পবিত্র কোরআনে এসেছে,
"তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান করো, তবে তা ভালো; আর যদি তা গোপনে করো এবং অভাবীদেরকে দাও, তবে তা আরও উত্তম। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন।" (সুরা বাকারা: আয়াত ২৭১)
৪. তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজ আদায় করা
রাতের নফল ইবাদত আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। রাসুল (সা.) বলেছেন,
"রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে? আমি তাকে তা প্রদান করব।’" (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪৫)
৫. জিকির, তাসবিহ ও দরুদ পাঠ
রমজানের এই মাগফিরাতের দিনগুলোতে বেশি বেশি জিকির ও দরুদ পাঠ করা উচিত। যেমন:
- সুবহানাল্লাহ ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম
- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ
- আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ
৬. দোয়া ও মোনাজাতে সময় কাটানো
রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন-
"তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।" (সূরা আল-মু’মিন: আয়াত ৬০)
৭. আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক উন্নতির চেষ্টা করা
মাগফিরাতের দশকে নিজেকে সকল পাপ ও খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করা উচিত।
🔹 রমজানের শেষ দশ দিন: নাজাতের দশক (জাহান্নাম থেকে মুক্তি)
রমজানের শেষ ১০ দিনকে নাজাত বা মুক্তির সময় বলা হয়। এই সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। যারা সত্যিকারের তওবা করে ও আল্লাহর পথে ফিরে আসে, তাদের জন্য চিরস্থায়ী মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত হয়।
রমজানের নাজাত অর্থ কি
নাজাত শব্দটি আরবি থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ মুক্তি বা পরিত্রাণ। ইসলামের দৃষ্টিতে, রমজানের নাজাত বলতে বোঝায় এই পবিত্র মাসের শেষ দশ দিনে আল্লাহর পক্ষ থেকে নরকের শাস্তি থেকে মুক্তির বিশেষ সুযোগ।
রমজানের নাজাত এর গুরুত্ব
নিচে নাজাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
১. জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিশেষ সুযোগ
রমজান মাস এমনিতেই বরকতময়, আর শেষ দশ দিন হলো গুনাহ থেকে মুক্তির সেরা সময়। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
"রমজানের প্রথম দশ দিন রহমতের, মধ্যের দশ দিন মাগফিরাতের, আর শেষ দশ দিন জাহান্নাম থেকে নাজাতের।" (তিরমিজি, হাদিস: ৬৮২)
অর্থাৎ, যারা এই সময় বেশি বেশি ইবাদত করবে, আল্লাহ তাদের গুনাহ ক্ষমা করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন।
২. গুনাহ মাফ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ
আমরা জানি, মানুষ মাত্রই ভুল করে, গুনাহ করে। কিন্তু আল্লাহর রহমত এত বিশাল যে, তিনি বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য অপেক্ষা করেন। রমজানের শেষ দশ দিনে অন্তরের গভীর থেকে তওবা করলে, আল্লাহ তায়ালা বান্দার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।
রাসুল (সা.) বলেছেন—
"যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন, যেন সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।" (মুসলিম, হাদিস: ২৭৬৭)
৩. ইতিকাফের মাধ্যমে নাজাত লাভ
রমজানের শেষ দশ দিনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো ইতিকাফ। যারা এই সময় মসজিদে বসে ইবাদত করে, তারা আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করে। ইতিকাফকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নাজাতের ঘোষণা রয়েছে।
৪. লাইলাতুল কদরের বরকত ও নাজাত
রমজানের শেষ দশ দিনের মধ্যে একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম – সেটি হলো লাইলাতুল কদর।
আল্লাহ বলেন—
"লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।" (সূরা আল-কদর: ৩)
এই রাতের ইবাদত করলে ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। যারা এই রাতে ইবাদত করে, তাদের জন্য নাজাতের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
৫. শয়তানের বন্ধন ও ভালো কাজের সহজ সুযোগ
রমজান মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, ফলে মানুষ সহজেই ভালো কাজ করতে পারে। শেষ দশ দিন আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার একটি স্বর্ণ সুযোগ, যা দুনিয়ার অন্য কোনো মাসে পাওয়া যায় না।
৬. জান্নাতের সুসংবাদ
যারা শেষ দশকে ইবাদত, দোয়া, তওবা ও দান-সদকা করে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন—
"যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশ দিন ইবাদতে কাটায়, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের সুসংবাদ দেন।" (বুখারি, হাদিস: ১৮০২)
নাজাত পাওয়ার দোয়া
রমজানের শেষ দশকে বিশেষ কিছু দোয়া রয়েছে, যা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য পড়া উত্তম।
১. লাইলাতুল কদরের দোয়া
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন:
"আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলাম: যদি আমি জানতে পারি যে লাইলাতুল কদর কখন, তাহলে আমি কী দোয়া করব?"
তিনি বলেন: তুমি এই দোয়াটি পড়বে-
- উচ্চারণ: "আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।"
- অর্থ: "হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।"(তিরমিজি: ৩৫১৩, ইবনে মাজাহ: ৩৮৫০)
২. ক্ষমা ও মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দোয়া
রমজানের শেষ দশকে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়তে বলা হয়েছে:
উচ্চারণ: রাব্বানা আকশিফ আন্নাল আজাবা ইন্না মুমিনুন। (সুরা দুখান: ১২)
অর্থ: "হে আমাদের প্রভু! আমাদের উপর থেকে শাস্তি তুলে নাও, আমরা ঈমান এনেছি।"
উচ্চারণ: রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন। (সুরা মুমিনুন: ১১৮)
অর্থ: "হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন; আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।"
উচ্চারণ: রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন। (সুরা মুমিনুন: ১০৯)
অর্থ: "হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি, তুমি আমাদের ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি দয়া করো।"
নাজাত পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমল
রমজানের শেষ দশকে নাজাত পাওয়ার জন্য কিছু বিশেষ আমল রয়েছে:
১. ইতেকাফ করা
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ দশকে মসজিদে ইতেকাফ করতেন। এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল।
২. কুরআন তিলাওয়াত করা
রমজান কুরআন নাজিলের মাস (সুরা বাকারা: ১৮৫)। তাই বেশি বেশি কুরআন পড়া উচিত।
৩. তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
"যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান ও নেক নিয়তে নামাজ পড়ে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।" (বুখারি: ১৯০১)
৪. বেশি বেশি ইস্তিগফার করা
"আমি প্রতিদিন ৭০ বার ইস্তিগফার করি।" (বুখারি: ৬৩০৭)
নাজাত পেতে বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়া উচিত:
- (উচ্চারণ: "আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়াতুবু ইলাইহি")
- (অর্থ: "আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাঁর দিকে ফিরে আসি।")
৫. দান-সদকা করা
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমজানে বেশি বেশি দান করতেন (বুখারি: ৬)।
সাহাবারা শেষ দশকে জাকাত ও সাদাকা দিতেন।
মন্তব্য
রমজান হলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এ মাসে আল্লাহর অসীম করুণা বর্ষিত হয়, গুনাহ ক্ষমা করা হয়, এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। আমাদের উচিত এই পবিত্র মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো—নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, জিকির ও সদকার মাধ্যমে।
বিশেষ করে শেষ দশ দিনে নাজাতের আমলগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যাতে আমরা আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারি।
আসুন, আমরা সবাই রমজানের এই বরকতময় সময়কে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত দান করুন। আমিন। 🤲
"রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দোয়া ও আমলসমূহ" বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন! ✨💬
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url