রমজানের রোজা: ফরজ, প্রকারভেদ, নিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (২০২৫)

রোজা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম। এটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। রোজা কত প্রকার ও কী কী, রমজানের রোজা কত হিজরীতে ফরজ হয়, রোজার ফরজ কয়টি, রোজা রাখার নিয়ত এবং রোজা ভঙ্গের কারণ—এসব বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে এই লেখাটি আপনাদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
রমজানের রোজা, ফরজ, প্রকারভেদ, নিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (২০২৫)
চলুন যেনে নেওয়া যাক "রমজানের রোজা: ফরজ, প্রকারভেদ, নিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (২০২৫)" সম্পর্কে বিস্তারিত।

ভূমিকা

রোজা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া ও ধৈর্য অর্জনের প্রধান মাধ্যম। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হলো রোজা, যা প্রতি বছর রমজান মাসে মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। রোজার মাধ্যমে একজন মুমিন নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।

রোজা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে, যেমন ফরজ রোজা, নফল রোজা, কাফফারার রোজা ও কাজা রোজা। রমজানের রোজা কত হিজরীতে ফরজ হয়েছে, রোজা রাখার ফরজ শর্তগুলো কী, রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে অনেকের জানার আগ্রহ থাকে। 

এই কন্টেন্ট এ আমরা রোজার প্রকারভেদ, ফরজ হওয়ার ইতিহাস, রোজার নিয়ত ও পালন বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে পাঠকরা রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পেতে পারেন।

রোজা কী?

রোজা (আরবি: صوم, সাওম) ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান সুবহে সাদিক (ভোরের আলো ফোটার সময়) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্পর্ক ও অন্য কিছু নির্দিষ্ট কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে। এটি শুধুমাত্র শারীরিক অনুশীলন নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

রোজার সংজ্ঞা

শরীয়তের পরিভাষায়, নিয়তের সাথে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্পর্ক এবং রোজা ভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা-কে রোজা বলা হয়।

রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত

রোজা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন ও হাদিসে রোজার অনেক ফজিলত উল্লেখ করা হয়েছে।

➡ আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন

"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।" 📖 (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)

➡ হাদিসে নববীতে বলা হয়েছে

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান ও নেক নিয়তে রমজানের রোজা পালন করে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (বুখারি ও মুসলিম)

রোজার উদ্দেশ্য ও উপকারিতা

রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম, ধৈর্য, তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। রোজার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো—
  • আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া বৃদ্ধি: রোজা মানুষকে গুনাহ থেকে বাঁচতে শেখায় এবং নৈতিকতা উন্নত করে।
  • ধৈর্য ও সহনশীলতা: ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করার মাধ্যমে ধৈর্যশীলতা বৃদ্ধি পায়।
  • গরিব-দুঃখীদের কষ্ট বোঝার সুযোগ: রোজার মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সমতা সৃষ্টি হয় এবং দান-সদকার প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
  • স্বাস্থ্যগত উপকারিতা: রোজার ফলে হজম প্রক্রিয়া বিশ্রাম পায়, ওজন নিয়ন্ত্রণ হয় এবং শরীরের টক্সিন দূর হয়।

রোজা এর প্রকারভেদ

রোজা ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জনের একটি মাধ্যম। ইসলামে বিভিন্ন প্রকারের রোজা রয়েছে, যেগুলো তাদের বিধান ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে। সাধারণভাবে রোজা প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত:
  • ফরজ রোজা
  • ওয়াজিব রোজা
  • নফল রোজা
  • মাকরুহ ও হারাম রোজা
নিচে প্রতিটি রোজার বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

১. ফরজ রোজা (যে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক)

ফরজ রোজা হচ্ছে সেই রোজা, যা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। এটি পালন না করলে গুনাহ হয় এবং কাফফারা আদায় করতে হয়।

ফরজ রোজার প্রকারভেদ

✅ রমজানের রোজা

প্রতি বছর রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি।

📖 আল-কুরআনে বলা হয়েছে:

"তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।" 📖 (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)

✅ কাজা রোজা

যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থতা, ভ্রমণ বা অন্য কোনো বৈধ কারণে রমজানের রোজা রাখতে না পারে, তবে পরে সেই রোজার কাজা আদায় করতে হবে।

✅ কাফফারা রোজা

যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভেঙে ফেলে, তবে তাকে কাফফারা দিতে হয়। কাফফারা হিসেবে একজন দাস মুক্ত করতে হবে, তা সম্ভব না হলে ৬০ দিন একটানা রোজা রাখতে হবে, অথবা ৬০ জন গরিবকে খাওয়াতে হবে।

২. ওয়াজিব রোজা (যে রোজা পালন করা অত্যাবশ্যকীয়)

ওয়াজিব রোজা ফরজের কাছাকাছি, তবে ফরজ নয়। এটি পালন করা আবশ্যক, কিন্তু কোনো কারণে ছুটে গেলে পরে তা কাজা করতে হয়।

✅ মানত রোজা

যদি কেউ আল্লাহর নামে মানত করে যে, “আমি যদি পরীক্ষায় ভালো ফল করি, তবে তিনদিন রোজা রাখব”, তাহলে সেই রোজা রাখা ওয়াজিব হয়ে যায়।

✅ কাজা রোজা

ফরজ রোজা কোনো কারণে ছুটে গেলে পরে তা আদায় করা ওয়াজিব।

৩. নফল রোজা (যে রোজা রাখা অতিরিক্ত সওয়াবের কাজ)

নফল রোজা বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি পালন করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যায়।

✅ দাউদ (আ.) এর রোজা

দাউদ (আ.) একদিন রোজা রাখতেন, আরেকদিন ভঙ্গ করতেন। এটি সর্বোত্তম নফল রোজা বলে গণ্য হয়।

✅ আরাফার দিনের রোজা

জিলহজ মাসের ৯ তারিখে রোজা রাখা বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ। নবী (সা.) বলেছেন, এটি গত বছরের ও পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফের কারণ হয় (মুসলিম, ১১৬২)।

✅ আশুরার রোজা

মহররম মাসের ১০ তারিখের রোজা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। তবে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখা সুন্নত।

✅ সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজা

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন।

✅ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রোজা

শবে বরাতের রাতে ইবাদত করা এবং পরের দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব।

✅ শাওয়ালের ৬ রোজা

রমজান মাসের পর শাওয়াল মাসে ৬ দিন রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায় (মুসলিম, ১১৬৪)।

✅ আইয়ামে বীজের রোজা

প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা সুন্নত।

৪. মাকরুহ ও হারাম রোজা (যে রোজা রাখা নিষিদ্ধ)

কিছু দিন রয়েছে যখন রোজা রাখা অনুচিত বা নিষিদ্ধ।
  • ❌ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখা হারাম।
  • ❌ তাশরিকের তিন দিন (১১, ১২, ১৩ জিলহজ) রোজা রাখা হারাম।
  • ❌ শুধু শুক্রবার বা শনিবার এককভাবে রোজা রাখা মাকরুহ।
  • ❌ গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে রোজা রাখা, যাতে শরীর বা সমাজের ক্ষতি হয়, সেটিও মাকরুহ হতে পারে।

রমজানের রোজা কত হিজরীতে ফরজ হয়?

রমজানের রোজা ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান ইবাদত এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য ফরজ করা হয়েছে, যিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং রোজা রাখার উপযুক্ত। রমজানের রোজা ২য় হিজরি সালে (৬২৪ খ্রিস্টাব্দে) ফরজ হয়েছে। অর্থাৎ, ইসলামের ইতিহাসে হিজরতের দুই বছর পর মদিনায় এই বিধান প্রবর্তিত হয়।

আল-কুরআনে রোজা ফরজ হওয়ার আদেশ

রোজা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারা-এর ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

👉 উচ্চারণ- "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন।"

👉 বাংলা অনুবাদ- "হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।" 📖 (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক।

হাদিসের আলোকে রোজার ফরজ হওয়া

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হাদিসের মাধ্যমে রমজানের রোজার গুরুত্ব ও ফরজিয়াতের কথা বর্ণনা করেছেন।

🔹 হাদিস

"ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত

  1. এ কথা সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।
  2. সালাত কায়েম করা।
  3. যাকাত প্রদান করা।
  4. রমজানের রোজা রাখা।
  5. সামর্থ্যবানদের জন্য হজ পালন করা।" 📖 (বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, রোজা ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত এবং এটি পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।

রোজার ফরজ কয়টি

রোজা বা সিয়াম ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি পালনের জন্য কিছু ফরজ বা আবশ্যিক শর্ত রয়েছে, যা পালন না করলে রোজা শুদ্ধ হবে না। ফকিহগণ রোজার তিনটি মূল ফরজ নির্ধারণ করেছেন, যা প্রতিটি রোজাদারের অবশ্যই মানতে হবে।

১. নিয়ত করা (সংকল্প করা)

রোজার প্রথম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো নিয়ত। নিয়ত মানে রোজা রাখার সংকল্প বা ইচ্ছা করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি রোজা রাখলেন অথচ নিয়ত করলেন না, তার রোজা শুদ্ধ হবে না।” (হাদিস)

এ কারণে রোজা রাখার জন্য অবশ্যই নিয়ত করতে হবে, যা রাতের বেলা বা সেহরির সময় করা উত্তম।

২. পানাহার এবং জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকা

রোজার দ্বিতীয় ফরজ হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকা।
  • কোনো ধরনের খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা যাবে না।
  • স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন থেকেও বিরত থাকতে হবে।
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, ধূমপান করা, বা অন্য কোনোভাবে রোজা ভঙ্গ হয় এমন কাজ করা নিষিদ্ধ।

৩. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোজা পালন করা

রোজার তৃতীয় ফরজ হলো নির্দিষ্ট সময় মেনে রোজা পালন করা। সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখতে হবে। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খায় বা পান করে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

রোজা রাখার নিয়ত ও ইফতারের দোয়া

রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ রহমতের সময়, যখন তারা রোজা পালন করে আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। রোজার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেহরি ও ইফতার এবং এই সময় নিয়ত ও দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রোজা রাখার নিয়ত

রোজা রাখার জন্য ফজরের আগে নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত মানে হলো রোজা রাখার দৃঢ় সংকল্প করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদত শুদ্ধ হয় না।" তাই রোজার জন্য সঠিক নিয়ত করা অপরিহার্য।

👉 উচ্চারণ-  নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।

👉 অর্থ- হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ করলাম। তুমি আমার রোজাকে কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

ইফতারের দোয়া

দিনব্যাপী রোজা রাখার পর ইফতার করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ এবং এই সময় দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
👉বাংলা উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।

👉 অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিজিকের মাধ্যমে ইফতার করছি।

রোজা ভঙ্গের কারণ

আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণ হেকমতের মাধ্যমে রোযার বিধান জারি করেছেন। তিনি রোযাদারকে ভারসাম্য বজায় রেখে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে রোযার কারণে তার শারীরিক ক্ষতি না হয় এবং সে রোজা ভঙ্গের কোনো কাজে লিপ্ত না হয়।

রোজা ভঙ্গের কারণগুলো দুই ভাগে বিভক্ত-

১. শরীর থেকে কিছু নির্গত হওয়ার কারণে রোজা ভঙ্গ হয়

যেসব কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, সেগুলো রোজা ভঙ্গকারী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন:
  • সহবাস
  • ইচ্ছাকৃত বমি করা
  • হায়েয ও নিফাস
  • শিঙ্গা লাগানো (বা এ জাতীয় কারণে রক্ত বের হওয়া)

২. শরীরে কিছু প্রবেশ করানোর কারণে রোজা ভঙ্গ হয়

যেসব কারণে রোযার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়, সেগুলোও রোজা ভঙ্গকারী। যেমন:
  • পানাহার (খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ)
  • যা কিছু পানাহারের স্থলাভিষিক্ত (যেমন রক্ত বা পুষ্টিকর ইনজেকশন নেওয়া)
আল্লাহ তাআলা বলেন:

“এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা তালাশ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো সুতা থেকে ভোরের শুভ্র সুতা পরিষ্কার ফুটে উঠে...” 📖 [সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭]

রোজা ভঙ্গের ৭টি কারণ

নিম্নে ৭টি প্রধান রোজা ভঙ্গের কারণ আলোচনা করা হলো:

১. সহবাস

রমযানের দিনের বেলা স্বেচ্ছায় স্ত্রী সহবাস করলে রোজা ভঙ্গ হবে এবং এর জন্য কাফফারা দিতে হবে। কাফফারা হিসেবে—
  • একটি ক্রীতদাস মুক্ত করা, অথবা
  • টানা ৬০ দিন রোযা রাখা, অথবা
  • ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো
📖 হাদিস: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে বলল: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ধ্বংস হয়েছি।’ নবীজি বললেন: ‘কিসে?’ সে বলল: ‘আমি রমযানের দিনে স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছি...’” 📚 [সহিহ বুখারী ১৯৩৬, সহিহ মুসলিম ১১১১]

২. হস্তমৈথুন

হস্তমৈথুন করলে রোজা ভঙ্গ হবে এবং কাযা করতে হবে। তবে, যদি বীর্যপাত না হয়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না।

📖 আল্লাহর বাণী: “সে আমার কারণে পানাহার ও যৌনকর্ম পরিহার করে।” 📚 [হাদিসে কুদসী]

৩. পানাহার (খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ)

মুখ বা নাক দিয়ে কোনো খাদ্য বা পানীয় পাকস্থলীতে গেলে রোজা ভঙ্গ হবে।

📖 হাদিস: “তুমি ভাল করে নাকে পানি দাও; যদি না তুমি রোজাদার হও।” 📚 [সুনানে তিরমিযি ৭৮৮]

৪. পানাহারের বিকল্প উপাদান গ্রহণ

যদি কোনো ব্যক্তি রক্ত গ্রহণ করে বা খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন নেয়, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

📖 ফতোয়া: “কিডনী ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে রক্ত পরিশোধন করে পুনরায় শরীরে প্রবেশ করানো হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।” 📚 [ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ১০/১৯]

৫. শিঙ্গা লাগানো বা রক্ত বের করা

যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগাবে বা বেশি পরিমাণে রক্ত দান করবে, তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।

📖 হাদিস: “যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় এবং যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোজা ভেঙ্গে যায়।” 📚 [সুনানে আবু দাউদ ২৩৬৭]

৬. ইচ্ছাকৃত বমি করা

যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হবে। তবে, স্বাভাবিকভাবে বমি হলে রোজা নষ্ট হবে না।

📖 হাদিস: “যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত বমি করবে তার রোজা ভঙ্গ হবে না; আর যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে, তার রোজা ভেঙ্গে যাবে।” 📚 [সুনানে তিরমিযি ৭২০]

৭. হায়েয ও নিফাস

নারীদের হায়েয (ঋতুস্রাব) বা নিফাস (প্রসব-পরবর্তী রক্ত) শুরু হলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে, এবং পরে তা কাযা করতে হবে।

📖 হাদিস: “নারীরা হায়েয অবস্থায় রোজা ছেড়ে দেয়, কিন্তু নামাজ কাযা করে না।” 📚 [সহিহ মুসলিম ৩৩৫]

২০২৫ সালে রোজা কত তারিখে শুরু হবে?

২০২৫ সালে পবিত্র রমজান মাস ১ মার্চ থেকে শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ইসলামী ক্যালেন্ডার ও মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদ দেখা যেতে পারে। যদি চাঁদ দেখা যায়, তাহলে ১ মার্চ থেকে রমজান শুরু হবে। তবে চাঁদ দেখা না গেলে একদিন পিছিয়ে ২ মার্চ থেকে রোজা শুরু হবে।

রমজানের চাঁদ দেখা ও তারিখ নির্ধারণ

ইসলামিক বর্ষপঞ্জি চন্দ্র গণনার ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রতি বছর রমজানের শুরুর তারিখ পরিবর্তিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাঁদ দেখার পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খালি চোখে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রমজানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কিছু পশ্চিমা দেশে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণনার ওপর ভিত্তি করে রমজানের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়।

মন্তব্য

রমজানের রোজা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি এবং এটি আত্মশুদ্ধির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, আত্মসংযম চর্চা এবং ইবাদতের মাধ্যমে সওয়াব অর্জনের বিশেষ সুযোগ এনে দেয় এই মাস। রোজার ফরজ বিধান, বিভিন্ন প্রকারভেদ, সঠিক নিয়ত এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা যথাযথভাবে রোজা পালন করতে পারি।

রমজানের এই পবিত্র সময় শুধু উপবাস থাকার নাম নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও তাকওয়া অর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের ফজিলত অর্জনের তৌফিক দান করুন এবং রোজার মূল তাৎপর্য অনুধাবন করার শক্তি দিন।

আপনার কাছে "রমজানের রোজা: ফরজ, প্রকারভেদ, নিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (২০২৫)" বিষয়বস্তুর কোন দিক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? আপনি কি মনে করেন, এই তথ্যগুলো আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা উচিত? আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ! কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত শেয়ার করুন এবং এই পবিত্র মাস সম্পর্কে আলোচনা করুন! 💬✨

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url