শবে কদর ২০২৫: হাদিসের আলোকে ফজিলত, আলামত ও করণীয় আমল

-
শবে কদর মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ রাত, যার ফজিলত অপরিসীম। হাদিসের আলোকে জানা যায়, শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এই রাতে আল্লাহর রহমত ও বরকত নাজিল হয়, আর মুমিনরা নফল নামাজ, দোয়া ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। তাই শবে কদরের আলামত সম্পর্কে জানা এবং করণীয় আমল সঠিকভাবে পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শবে কদর, হাদিসের আলোকে ফজিলত, আলামত ও করণীয় আমল
চলুন যেনে নেওয়া যাক "শবে কদর ২০২৫: হাদিসের আলোকে ফজিলত, আলামত ও করণীয় আমল" সম্পর্কে বিস্তারিত।

ভূমিকা

শবে কদর মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহিমান্বিত রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। পবিত্র কুরআনে এবং বিভিন্ন হাদিসে শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য অশেষ রহমত ও মাগফিরাতের দরজা খুলে দেন। 

যারা এই রাতকে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটায়, তারা বিশেষ সওয়াব অর্জন করে। তাই শবে কদরের আলামত চেনা, হাদিসের আলোকে এর গুরুত্ব বোঝা এবং করণীয় আমল সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেন আমরা এই রাতের পূর্ণ ফায়দা নিতে পারি।

শবে কদর

শবে কদর, যা আরবি ভাষায় লাইলাতুল কদর নামে পরিচিত, ইসলামে এক মহিমান্বিত ও সম্মানিত রাত। "শবে" শব্দটি ফার্সি ভাষায় রাত বোঝায়, আর "কদর" শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা ও তাকদির নির্ধারণ। তাই শবে কদর অর্থ ‘মহিমান্বিত রাত’ বা ‘অতিশয় পুণ্যময় রজনী’।

ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দার জন্য অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করেন এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করেন। কুরআনুল কারিমের বর্ণনা অনুসারে, শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াবের অধিকারী।

শবে কদর মাহে রমজানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লুকায়িত থাকে, বিশেষ করে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রাতে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয় এবং ফেরেশতারা দুনিয়ায় নেমে আসে। তাই শবে কদরের ফজিলত অর্জনের জন্য মুসলমানরা নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও অন্যান্য আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।

শবে কদরের ইতিহাস

শবে কদর ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত ও বরকতের প্রতীক। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, ৬১০ সালে এই পবিত্র রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর প্রথম ওহি নাজিল হয়। তিনি তখন মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনের প্রথম পাঁচটি আয়াত (সূরা আলাকের শুরু) তাঁর কাছে নিয়ে আসেন।

এই রাতেই সম্পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে নাজিল করা হয় এবং পরবর্তী ২৩ বছর ধরে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে নবী করিম (সাঃ)-এর ওপর আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

শবে কদরের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআনে সূরা কদর নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, "শবে কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম" (সূরা কদর ৯৭:৩)। এর অর্থ, এই রাতে করা ইবাদত ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব অর্জনের সুযোগ দেয়।

ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী, আগের নবী ও তাঁদের অনুসারীরা দীর্ঘ জীবন পেতেন এবং বহু বছর ধরে আল্লাহর ইবাদত করতেন। যেমন, নবী আইয়ুব (আ.), জাকারিয়া (আ.), হিযকীল (আ.) ও ইউশা ইবনে নূন (আ.) প্রায় ৮০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ইবাদত করেছেন, এবং তাঁরা কখনো গুনাহের কাজে লিপ্ত হননি। 

কিন্তু ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতদের গড় আয়ু কম হওয়ায় তাঁদের পক্ষে এত দীর্ঘ সময় ইবাদত করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ শবে কদরকে দান করেছেন, যাতে এই এক রাতের ইবাদত দ্বারা দীর্ঘ সময়ের ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়।

এই মহিমান্বিত রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই শবে কদর সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস পাওয়া যায়, যা মুসলমানদেরকে এই রাতের ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।

শবে কদরের ফজিলত ও গুরুত্ব

শবে কদর (লাইলাতুল কদর) হলো ইসলাম ধর্মের এক মহিমান্বিত ও বরকতময় রাত। এটি পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয় এবং ফেরেশতারা পৃথিবীতে নেমে আসেন।

শবে কদরের ধর্মীয় গুরুত্ব

শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন—

❝ নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাঈল আ.) তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রতিটি কাজে অবতীর্ণ হয়। শান্তি, শান্তি! তা ফজর পর্যন্ত বিরাজমান। ❞ 📖 (সুরা কদর: ১-৫)

এছাড়াও, অন্যত্র বলা হয়েছে—

❝ হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের! নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। ❞ 📖 (সুরা আদ-দুখান: ১-৪)

শবে কদরের ফজিলত ও বিশেষত্ব

১. হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রাত

শবে কদরের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব এনে দেয়। হাজার মাস মানে প্রায় ৮৩ বছর ৪ মাস। অর্থাৎ, এই এক রাতের ইবাদতের সওয়াব ৩০,০০০ রাতের চেয়েও বেশি!

২. কুরআন অবতীর্ণের রাত

শবে কদরের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হলো, এই রাতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। কুরআন মানবজাতির জন্য পথনির্দেশিকা, যা এই রাতকে আরও মর্যাদাপূর্ণ করেছে।

৩. গুনাহ মাফের সুযোগ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—

❝ যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়ে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। ❞ 📖 (বুখারি: ২০১৪, মুসলিম: ৭৬০)

৪. ফেরেশতাদের আগমন ও রহমতের বর্ষণ

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে—

❝ এই রাতে ফেরেশতারা ও হযরত জিবরাঈল (আ.) দুনিয়াতে নেমে আসেন এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য রহমত ও দোয়া করেন। ❞ (মাজহারি)

৫. ভাগ্য নির্ধারণের রাত

শবে কদরের রাতে মানুষের জীবন, মৃত্যু, রিজিক ও ভাগ্য নির্ধারিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

❝ এই রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। ❞ 📖 (সুরা আদ-দুখান: ৪)

শবে কদর কখন হয়?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

❝ তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো। ❞ 📖 (বুখারি: ২০১৭, মুসলিম: ১১৬৫)

অর্থাৎ, রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতের মধ্যে একটি হল শবে কদর। তবে বেশিরভাগ ইসলামিক স্কলারদের মতে ২৭ রমজানের রাত শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিস

লাইলাতুল কদর হলো একটি বিশেষ রজনী, যা রমজানের শেষ দশকে বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটিতে অবস্থান করে। এই রাতের ইবাদতের মর্যাদা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি। নিচে কিছু বিশিষ্ট হাদিস তুলে ধরা হলো, যা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব, ফজিলত ও অনুসন্ধানের নির্দেশনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে—

১. লাইলাতুল কদরে ইবাদতের ফজিলত

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

"যে ব্যক্তি রমাযানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।" 📚(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২০১৪; আধুনিক প্রকাশনী: ১৮৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ১৮৮৪)

🔹 এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, লাইলাতুল কদরের রাতে ইবাদত করলে অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

২. লাইলাতুল কদরের সন্ধান করার নির্দেশনা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উৎসাহিত করেছেন লাইলাতুল কদরের সন্ধান করতে। ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

"রমাযানের শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর।" 📚(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২০১৫; মুসলিম, ১৩/৪০; হাদিস নং ১১৬৫; আহমাদ, ৪৫৪৭)

একইভাবে, আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) বর্ণনা করেন:

"আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর।" 📚(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২০১৬; আধুনিক প্রকাশনী: ১৮৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ১৮৮৬)

🔹 এই হাদিস অনুযায়ী, লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ সাত রাতের মধ্যে খোঁজার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৩. লাইলাতুল কদরের সঠিক তারিখ গোপন রাখা হয়েছে

আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রমাযানের মধ্যম দশকে ই‘তিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমাকে লাইলাতুল কদর (-এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল, পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর। 

আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে (মসজিদ হতে বের হয়ে না যায়)। আমরা সকলে ফিরে আসলাম (থেকে গেলাম)। আমরা আকাশে হাল্কা মেঘ খন্ডও দেখতে পাইনি। 

পরে মেঘ দেখা দিল ও এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। সালাত শুরু করা হলে আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই। 📖 (সহিহ বুখারি-আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৬)

’উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লাইলাতুল কদরের (নির্দিষ্ট তারিখ) অবহিত করার জন্য বের হয়েছিলেন। তখন দু’জন মুসলিম ঝগড়া করছিল। 

তা দেখে তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দিবার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুক ঝগড়া করছিল, ফলে তার (নির্দিষ্ট তারিখের) পরিচয় হারিয়ে যায়। সম্ভবতঃ এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তা তালাশ কর। 📖 (সহিহ বুখারি-আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯৩)

🔹 এখানে বোঝা যায়, লাইলাতুল কদরের সঠিক তারিখ মানুষের জানার বাইরে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ বেশি বেশি ইবাদতে মনোযোগী হয়।

৪. লাইলাতুল কদরে বেশি বেশি ইবাদত করার নির্দেশনা

আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রমাযানের শেষ দশক আসত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। 📖 (মুসলিম ১৪/৩, হাঃ ১১৭৪)

শবে কদরের আলামত সমূহ

শবে কদর একটি মহিমান্বিত রাত, যা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে শবে কদরের কিছু আলামতের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা দ্বারা এ রাতটি চেনা যেতে পারে।

শবে কদরের আলামতসমূহ হাদিসের আলোকে:
  1. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না – শবে কদরের রাতটি খুব শান্ত ও মনোরম হবে। এই রাতে কোনো অতিরিক্ত অন্ধকার নেমে আসবে না। 📖 (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ: ২১৯০; বুখারী: ২০২১; মুসলিম: ৭৬২)
  2. নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ – অর্থাৎ রাতটি খুব বেশি গরম বা ঠাণ্ডা হবে না, বরং আরামদায়ক হবে। 📖 (ইবনে খুযাইমা : ২১৯২)
  3. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হবে – আবহাওয়া থাকবে স্বাভাবিক ও প্রশান্তিময়, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন থাকবে না। 📖 (মাজমাউজ জাওয়ায়িদ : ৩/১৭৯)
  4. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ বিশেষ তৃপ্তিবোধ করবে – মানুষ সে রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মতৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করবে। 📖 (মুসলিম : ১৬৭০)
  5. কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারেন – এটি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের অংশ, যে কোনো সত্যনিষ্ঠ মুসলিমকে আল্লাহ এ রাত সম্পর্কে স্বপ্নে অবগত করতে পারেন। 📖 (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ: ২১৯০)
  6. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে – অনেক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, শবে কদরের রাতে বৃষ্টি হতে পারে, যা আল্লাহর রহমতের প্রতীক। 📖 (সহীহ বুখারী: ১৮৮৬)
  7. সকালে সূর্যোদয় হবে মৃদু আলোকরশ্মিসহ – শবে কদরের পরবর্তী সকালে সূর্য উঠবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো, যার আলো হবে কোমল এবং দৃষ্টিনন্দন, কোনো তীব্রতা থাকবে না। 📖 (মুসলিম: ১৬৭০, মুসনাদ আহমাদ: ২২৭৬৫, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ: ২১৯০)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

"ওই রাতের আলামত হলো, রাত শেষে সকালে সূর্য উদিত হবে, তা উজ্জ্বল হবে, কিন্তু তার কোনো তীব্র আলোকরশ্মি থাকবে না।" 📖 (মুসলিম: ১৬৭০)

হজরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন,

"লাইলাতুল কদর স্বচ্ছ একটি রাত হবে, না গরম, না ঠাণ্ডা। সে রাতে কোনো উল্কাপিণ্ড দেখা যাবে না এবং সকাল পর্যন্ত আকাশে প্রশান্তি বিরাজ করবে।" 📖 (মুসনাদ আহমাদ: ২২৭৬৫)

এ সমস্ত আলামত দ্বারা শবে কদরের রাতকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা যায়, তবে সবচেয়ে উত্তম হলো, রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য দোয়া করা।

শবে কদর নামাজের নিয়ম

শবে কদর, বা লাইলাতুল কদর, হলো ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করলে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। তাই মুসলমানরা এ রাতে বিশেষ ইবাদত ও নামাজ আদায় করে। নিচে শবে কদর নামাজের নিয়ম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করা হলো।

শবে কদর নামাজের নিয়ত

শবে কদরের রাতে যে কোনো নফল নামাজ পড়া যায়, তবে সাধারণত দুই রাকাত করে নামাজ আদায় করা উত্তম। নামাজ শুরুর আগে নিয়ত করতে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, দুই রাকাত নামাজের নিয়ত হতে পারে—

নিয়ত: (আমি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করার নিয়ত করছি, আল্লাহু আকবার।)

শবে কদর নামাজ কত রাকাত

শবে কদরের নির্দিষ্ট কোনো রাকাত নেই, তবে অনেকে ৮, ১২ বা ২০ রাকাত নামাজ আদায় করেন। যেহেতু এটি নফল নামাজ, তাই যে যত বেশি পড়বে, সে তত বেশি সওয়াব অর্জন করতে পারবে।

শবে কদর দোয়া

শবে কদরের বিশেষ দোয়া হলো:
  • উচ্চারণ: "আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি"
  • অর্থ: "হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে ভালোবাসো, অতএব আমাকে ক্ষমা করো।"
এই দোয়াটি নবী মুহাম্মদ (সা.) শবে কদরে পড়তে বিশেষভাবে সুপারিশ করেছেন।

শবে কদরের বিশেষ আমল

শবে কদরের রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

❝ তোমরা এ রাতের ইবাদতে ব্যস্ত থাকো। বেশি বেশি দোয়া, তাসবিহ ও ইস্তিগফার করো। ❞ (তিরমিজি: ৩৫১৩)

🔹 নামাজ: এ রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া উত্তম।
🔹 কুরআন তিলাওয়াত: কুরআন পড়লে অসংখ্য সওয়াব লাভ হয়।
🔹 দোয়া ও ইস্তিগফার: বিশেষ করে এই দোয়াটি পড়া উত্তম—
📜 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি।
📜 অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, আমাকে ক্ষমা করুন।”
🔹 জিকির ও তাসবিহ: “সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার” বেশি বেশি বলা উচিত।
🔹 সদকা ও দান: এ রাতে দান-সদকা করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

মন্তব্য

শবে কদর হলো এমন একটি রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এটি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, যেখানে বান্দাদের গুনাহ মাফের সুযোগ দেওয়া হয় এবং রহমত, বরকত ও মুক্তির দরজা উন্মুক্ত করা হয়। এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়, যা আমাদেরকে এই মহিমান্বিত রাতের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে। 

শবে কদরের আলামতগুলো আমাদের এই রাতকে চিনতে সহায়তা করে, তবে মূল বিষয় হলো—আমরা যেন নির্ধারিত রাতগুলোতে ইবাদতে মশগুল থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করি।

শবে কদরের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ ও দোয়া করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই রাতের ফজিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

"শবে কদর ২০২৫: হাদিসের আলোকে ফজিলত, আলামত ও করণীয় আমল" সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে ও শবে কদর সম্পর্কে আরও আলোচনা করতে নিচের কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করুন।

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url