শবে বরাত: অর্থ, ফজিলত, সুন্নাহ-সম্মত আমল ও ভুল ধারণা
শবে বরাত হল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের শাবান মাসের ১৫তম রাত, যা বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন এবং রহমত নাজিল করেন। তবে, শবে বরাতের সুন্নাহ-সম্মত আমল ও বিদআত নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, যা পরিহার করা জরুরি। এই কন্টেন্টে শবে বরাতের অর্থ, ফজিলত, সহিহ ইবাদত ও প্রচলিত ভিত্তিহীন আমল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "শবে বরাত: অর্থ, ফজিলত, সুন্নাহ-সম্মত আমল ও ভুল ধারণা" সম্পর্কে বিস্তারিত। এই কন্টেন্টটি আপনাকে শবে বরাতের সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এবং বিদআত ও ভিত্তিহীন আমল থেকে দূরে থাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিবে।
ভূমিকা
শবে বরাত হল ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে পালিত হয়।। এই রাতকে ক্ষমা, রহমত ও মুক্তির রাত বলা হয়। এই রাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য বান্দার গুনাহ ক্ষমা করেন, ভাগ্য নির্ধারণ করেন এবং রহমতের দরজা খুলে দেন। মুসলমানরা এই রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন এবং আল্লাহর নিকট গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করেন।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে, এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করলে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। তবে শবে বরাত উপলক্ষে অনেক বিদআত ও ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা এ রাতের মূল তাৎপর্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তাই এই বিশেষ রাতের করণীয় আমল, নিষিদ্ধ কাজ ও ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা জরুরি, যাতে আমরা শুদ্ধভাবে ইবাদত করতে পারি এবং আল্লাহর রহমত লাভ করতে সক্ষম হই।
শবে বরাত: অর্থ ও গুরুত্ব
শবে বরাত শব্দটি দুটি আরবি শব্দ "শব" এবং "বরাত" থেকে এসেছে। "শব" অর্থ রাত, আর "বরাত" অর্থ মুক্তি বা ক্ষমা। অর্থাৎ, শবে বরাত হচ্ছে এমন একটি রাত, যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, রহমতের দরজা খুলে দেন এবং অনেককে মুক্তির ঘোষণা দেন।
ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষায় জানা যায়, শাবান মাসের ১৫তম রাত (এখানে ১৫ শাবানের রাত বলা হয়েছে, যা কার্যত ১৪ শাবানের দিনের পরের রাতকেই বোঝায়।) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের প্রতি রহমত নাজিল করেন। তবে এই রাতের নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়, বরং আল্লাহর ক্ষমা লাভের উদ্দেশ্যে সাধারণ ইবাদত, তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়া করা যেতে পারে।
শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস
শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনী নিয়ে অনেক হাদীস পাওয়া যায়। তবে এসব হাদীসের মধ্যে কিছু সহীহ, কিছু দুর্বল (যয়ীফ) এবং কিছু সম্পূর্ণ বানোয়াট (জাল) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানে আমরা শবে বরাত সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদীসের বিশ্লেষণ করবো এবং সহীহ ও জাল হাদীসগুলোর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরবো।
১. মধ্য শাবানের রাত্রির ফজিলত ও মাগফিরাত
এ বিষয়ে সহীহ হাদীস পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
"নিশ্চয়ই আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।" (তিরমিজি, ইবনু মাজাহ, আহমাদ, সহীহ আলবানী)
এই অর্থের হাদীস বিভিন্ন সাহাবীর সূত্রে পাওয়া যায়, যেমন—আবূ মূসা আশআরী, আবু হুরাইরা, আয়েশা (রা.)। যদিও কিছু সনদ দুর্বল, তবে হাদীসের বহুসংখ্যক সূত্র থাকার কারণে এটি গ্রহণযোগ্য ও সহীহ বলে বিবেচিত হয়েছে।
তবে, এখানে কোনো নির্দিষ্ট ইবাদতের কথা উল্লেখ নেই। শুধু বলা হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ বান্দাদের ক্ষমা করেন।
২. মধ্য শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন
কিছু হাদীসে বলা হয়েছে, মধ্য শাবানের রাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়, হায়াত-মউত নির্ধারিত হয়।
কুরআনের আয়াত:
"আমি এক বরকতময় রজনীতে এটি (কুরআন) নাযিল করেছি, এই রাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।" (সূরা আদ-দুখান: ৩-৪)
কিছু ব্যাখ্যাকারী একে শবে বরাত বলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে রমজানের লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে, শবে বরাত নয়।
সুতরাং, মধ্য শাবানের রাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীসগুলো দুর্বল বা বানোয়াট বলে গণ্য হয়েছে।
৩. শবে বরাতের রাতে বিশেষ দোয়া ও ইবাদত
কিছু হাদীসে এসেছে, মধ্য শাবানের রাতে বিশেষভাবে দোয়া-মুনাজাত করলে তা কবুল হয়। তবে, এই অর্থের কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায়নি। যে হাদীসগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে কিছু দুর্বল এবং কিছু সম্পূর্ণ জাল।
সুতরাং, এই রাতে দোয়া করা যেতে পারে, তবে এটাকে বাধ্যতামূলক বা বিশেষ গুরুত্বের দাবি করা ঠিক নয়।
৪. শবে বরাতে নির্দিষ্ট নামাজের প্রচলন
অনেক জায়গায় বলা হয়, শবে বরাতের রাতে ১০০ রাকাত নামাজ পড়লে অসংখ্য সওয়াব পাওয়া যায় বা ৬ রাকাত নামাজ পড়লে দীর্ঘ জীবন ও ভালো রিজিক লাভ হয়। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই ধরণের নির্দিষ্ট নামাজের হাদীসগুলো বানোয়াট (জাল)।
ইমাম ইবনুল জাওযি, ইবনু তাইমিয়া, ইমাম নববী এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ স্পষ্টভাবে বলেছেন, শবে বরাতের নির্দিষ্ট রাকআত নামাজের হাদীসগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
তাহাজ্জুদ নামাজ, সাধারণ দোয়া-ইস্তেগফার করা যেতে পারে, তবে বিশেষ কোনো নিয়ম বা নির্দিষ্ট নামাজের ফজিলতের দাবি করা ঠিক নয়।
৫. শবে বরাতের রাতে কবর জিয়ারত
কিছু হাদীসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) শবে বরাতে কবরস্থানে গিয়েছেন।
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন,
"এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে খুঁজতে গিয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে আছেন।"
(মুসলিম: ৯৭৪)
কিন্তু এই হাদীসে শবে বরাতের কোনো উল্লেখ নেই। এটি সাধারণভাবে কবর জিয়ারতের গুরুত্ব নিয়ে এসেছে, শবে বরাতের বিশেষ কিছু বোঝানো হয়নি।
৬. শবে বরাতের রাতে হালুয়া-রুটি বা অন্য কিছু খাওয়া
অনেক সংস্কৃতিতে শবে বরাতে হালুয়া-রুটি খাওয়ার বিশেষ প্রচলন রয়েছে। তবে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর কোনো ভিত্তি নেই।
শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ খাবার তৈরি, মিষ্টান্ন বিতরণ ইত্যাদির কোনো নির্দেশনা কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না।
শবে বরাত সম্পর্কে সুন্নাহসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি
১. শবে বরাতের গুরুত্ব: আল্লাহ এ রাতে বান্দাদের ক্ষমা করেন, তবে এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের কথা বলা হয়নি।
২. বিদআত পরিহার: নির্দিষ্ট রাকআত নামাজ, বিশেষ দোয়া বা ভাগ্য লিখনের ধারণা ভিত্তিহীন।
৩. কবর জিয়ারত করা জায়েজ, তবে এটাকে শবে বরাতের বিশেষ আমল হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়।
৪. হালুয়া-রুটির মতো কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা উচিত।
শবে বরাত উপলক্ষে করণীয় ও সুন্নাহসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি
শবে বরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়া বর্ষণ করেন এবং অনেককে ক্ষমা করেন। তবে এই রাতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত অনেক ভুল ধারণা ও বিদআত রয়েছে, যা এড়িয়ে চলা উচিত। শবে বরাতের ফজিলত পাওয়ার জন্য আমাদের কিছু সুন্নাহসম্মত করণীয় রয়েছে, যা কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত।
১. তওবা ও ইস্তেগফার করা
শবে বরাতের মূল তাৎপর্য হলো আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা। এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন, তবে শর্ত হলো—বান্দাকে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ফিরে আসতে হবে।
✅ কীভাবে তওবা ও ইস্তেগফার করবেন?
- আন্তরিকভাবে নিজের গুনাহ স্বীকার করা
- ভবিষ্যতে ওই গুনাহ না করার প্রতিজ্ঞা করা
- বেশি বেশি "আস্তাগফিরুল্লাহ" বলা
- আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করা
- যাদের হক নষ্ট করেছেন, তাদের হক আদায় করা
🔹 রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
"যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মতো বেশি হয়।" (তিরমিজি: ৩৫৭৭)
তাই শবে বরাতের রাতে আমাদের উচিত অতীতের ভুলগুলো নিয়ে অনুতপ্ত হওয়া, বেশি বেশি তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
২. নফল ইবাদত করা (নির্দিষ্ট কোনো শর্ত ছাড়া)
শবে বরাতের রাতে আলাদা কোনো নামাজ নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে স্বাভাবিকভাবে নফল নামাজ পড়া যায়।
✅ নফল ইবাদতের কিছু সুন্নাহসম্মত আমল
- তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া
- স্বাভাবিকভাবে ২ বা ৪ রাকআত নফল নামাজ পড়া
- দীর্ঘ সময় সেজদায় থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করা
❌ কিন্তু যেসব বিদআত পরিহার করা উচিত
- ৬ বা ১০০ রাকআত নির্দিষ্ট করে নামাজ পড়া
- বিশেষ কোনো সুরা দিয়ে নামাজ পড়া
- মনে করা যে, শবে বরাতের নামাজ পড়লেই গুনাহ মাফ হয়ে যাবে
🔹 ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন
"শবে বরাতের রাতে নামাজ পড়ার ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট দলিল নেই। তবে কেউ চাইলে সাধারণভাবে নফল নামাজ পড়তে পারে।" (মাজমু ফাতাওয়া: ২৩/১৩২)
৩. কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া করা
এই রাতে কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া করা উত্তম। কুরআন তিলাওয়াত হৃদয়কে প্রশান্ত করে এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের অনুভূতি বৃদ্ধি করে।
✅ কীভাবে এই রাতের দোয়া করবেন?
- আল্লাহর গুণবাচক নাম (আসমাউল হুসনা) পড়ে দোয়া করুন
- রিজিক বৃদ্ধি, গুনাহ মাফ ও জান্নাতের দোয়া করুন
- নিজের ও পরিবারের জন্য দোয়া করুন
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর শিখানো দোয়া পড়তে পারেন:
اللهم إنك عفو كريم تحب العفو فاعف عني
"হে আল্লাহ! তুমি পরম ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো, আমাকেও ক্ষমা করে দাও।" (তিরমিজি: ৩৫১৩)
🔹 হাদিসে বর্ণিত আছে:
"এই রাতে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সবাইকে ক্ষমা করেন, শুধু দুই শ্রেণির মানুষ ছাড়া—(১) যারা শিরক করে এবং (২) যারা মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।" (ইবনু মাজাহ: ১৩৯০)
৪. বিদআত ও ভিত্তিহীন আমল থেকে দূরে থাকা
শবে বরাতের রাত সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, যা সুন্নাহ বিরোধী ও বিদআত।
❌ শবে বরাত উপলক্ষে যে কাজগুলো করা উচিত নয়:
- নির্দিষ্ট রাকআতের নামাজ পড়া—১০০ রাকআত বা ৬ রাকআত নামাজের কোনো প্রমাণ নেই।
- শবে বরাতের বিশেষ কোনো দোয়া বা আমল নির্ধারণ করা—এমন কোনো নির্ভরযোগ্য হাদিস নেই।
- কবর জিয়ারতকে বাধ্যতামূলক মনে করা—কবর জিয়ারত জায়েজ, তবে শবে বরাতের জন্য নির্দিষ্ট নয়।
- হালুয়া-রুটি, আতশবাজি, মিষ্টি বিতরণ ইত্যাদি করা—এগুলোর কোনো ইসলামিক ভিত্তি নেই।
- 🔹 ইমাম ইবনু কাসির (রহ.) বলেছেন:
- "শবে বরাত সম্পর্কে অনেক হাদিস পাওয়া যায়, তবে অধিকাংশই জইফ (দুর্বল) বা মওদু (জাল)। এই রাতে নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই।" (তাফসির ইবনু কাসির: সূরা আদ-দুখান)
শবে বরাত নামাজ কত রাকাত
শবে বরাতের রাতে নির্দিষ্ট কোনো নামাজের কথা কুরআন বা সহিহ হাদিসে উল্লেখ নেই। তবে, এটি একটি ফজিলতের রাত হওয়ায়, এই রাতে নফল নামাজ, ইস্তেগফার ও তওবা করা যায়। কেউ চাইলে তাহাজ্জুদ নামাজের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন, তবে এটাকে শবে বরাতের বিশেষ নির্দিষ্ট নামাজ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
নফল নামাজের বিধান
যদি কেউ শবে বরাতের রাতে নামাজ আদায় করতে চান, তাহলে তিনি সাধারণ নফল নামাজ পড়তে পারেন। সাধারণভাবে নফল নামাজ দুই রাকাত করে আদায় করা উত্তম। তাহাজ্জুদ নামাজের মতোই ২, ৪, ৬, ৮ বা তার বেশি রাকাত পড়া যায়। তবে এই রাতে ১০০ রাকাত বা ১২ রাকাতের নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ নামাজ পড়ার কথা হাদিসে পাওয়া যায় না।
শবে বরাত নামাজের নিয়ত
শবে বরাতের রাতে বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট নামাজের বিধান কুরআন বা সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না। তবে, এটি একটি ফজিলতের রাত হওয়ায়, কেউ চাইলে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন। এই ইবাদত একান্তই ব্যক্তিগত এবং বিশেষ কোনো শর্তযুক্ত নয়।
নফল নামাজের নিয়ত
নফল নামাজ পড়ার সাধারণ নিয়ম অনুসারে শবে বরাতের রাতেও যে কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নফল নামাজ পড়তে পারেন। নিয়ত করার সময় মনে রাখতে হবে, এই নামাজ শবে বরাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নামাজ নয়, বরং এটি সাধারণ নফল ইবাদত।
নিয়ত করার পদ্ধতি (বাংলায়)
"আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করছি, আল্লাহু আকবর।"
👉 গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: নিয়ত মনে করলেই যথেষ্ট, মুখে উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক নয়।
❌শবে বরাত উপলক্ষে কিছু ভুল ধারণা ও বিদআত
শবে বরাতের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না, তবে কিছু ভুল ধারণা ও বিদআত পরিহার করা জরুরি।
১. নির্দিষ্ট রাকআত নামাজ ও দোয়া: ভিত্তিহীন আমল
অনেকের মধ্যে একটি প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে, শবে বরাতের রাতে নির্দিষ্ট রাকআতের বিশেষ নামাজ পড়তে হয়, যা "সালাতুল খায়র" নামে পরিচিত। কেউ কেউ মনে করেন, ১০০ রাকআত বা ৬ রাকআত বিশেষ নামাজ পড়লে বিশেষ সওয়াব পাওয়া যায়।
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ ধরনের নির্দিষ্ট নামাজের কোনো সহীহ হাদীস নেই। ইমাম ইবনু তাইমিয়া, ইমাম নববী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ একে ভিত্তিহীন বলেছেন। তাই এ ধরনের নির্দিষ্ট আমল প্রচার করা বিদআত হিসেবে গণ্য হয়।
২. ভাগ্য লিখন ও রিজিক নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারণা
অনেকে মনে করেন, শবে বরাতের রাতে মানুষের ভাগ্য, রিজিক ও হায়াত-মউত নির্ধারণ করা হয়।
এর পক্ষে যে আয়াত পেশ করা হয়, তা হলো:
"আমি এক বরকতময় রাতে এটি (কুরআন) নাযিল করেছি, এই রাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।" (সূরা আদ-দুখান: ৩-৪)
তবে অধিকাংশ মুফাসসির একমত যে, এখানে ‘বরকতময় রজনী’ বলতে রমজানের লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে, শবে বরাত নয়। তাই শবে বরাতের রাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয়—এমন বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই।
৩. কবর জিয়ারত: জায়েজ তবে বাধ্যতামূলক নয়
কিছু হাদীসে পাওয়া যায় যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) শাবান মাসের এক রাতে কবর জিয়ারত করেছেন। তবে সেটি যে শবে বরাত ছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ নেই।
মুসলিম শরীফে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি এক রাতে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে দেখতে পান। তবে সেখানে শবে বরাতের কোনো উল্লেখ নেই।
সুতরাং, যদি কেউ স্বাভাবিকভাবে কবর জিয়ারত করতে চান, তবে তা করা যেতে পারে, তবে এটাকে শবে বরাতের নির্দিষ্ট আমল হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়।
৪. হালুয়া-রুটি ও বিশেষ আয়োজন: ভিত্তিহীন প্রচলন
শবে বরাত উপলক্ষে অনেক সংস্কৃতিতে বিশেষ খাবার, হালুয়া-রুটি বিতরণ, আতশবাজি ফোটানো ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে।
কিন্তু এসবের কোনো ইসলামিক ভিত্তি নেই। ইসলামিক বিধানে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট খাবারের কোনো কথা বলা হয়নি। তাই শবে বরাতের সাথে খাবারের বিশেষ আয়োজন করা বিদআত ও কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত।
শবে বরাতের রোজা: ফজিলত ও করণীয়
শবে বরাতের রোজার বিষয়ে একটি হাদিস পাওয়া যায়, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
"যখন শাবান মাসের মধ্য দিবস (১৫ শাবান) আসে, তখন তোমরা রাতটি ইবাদতে কাটাও এবং দিনটিতে রোজা রাখো।" (ইবনু মাজাহ: ১৩৮৪)
যদিও এই হাদিসটির সনদ দুর্বল, তবে এর প্রথম অংশ—রাতের ইবাদত করার বিষয়টি অন্যান্য সহিহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত। তবে রোজা রাখার ব্যাপারটি শুধু এই বর্ণনায় এসেছে।
১৫ শাবানের রোজার গুরুত্ব
শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার বিষয়ে বিভিন্ন সহিহ হাদিস পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাসে প্রচুর নফল রোজা রাখতেন।
হাদিসে এসেছে,
হজরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, "হে আবু যার! যখন তুমি মাসের মধ্যে তিন দিন রোজা রাখবে, তবে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখবে।" (তিরমিজি, নাসাঈ, মিশকাত)
১৫ শাবান আইয়ামে বিজ (চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) এর অন্তর্ভুক্ত, যে দিনগুলোতে রোজা রাখা সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি চান্দ্র মাসের এই তিন দিন রোজা রাখতেন, যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
শাবান মাসের নফল রোজার ফজিলত
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন,
"শাবানের ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিষয়ে নিষেধ নেই, কারণ এটি আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতি চান্দ্র মাসের এই তারিখে রোজা রাখা সুন্নাহ। এ ছাড়া রাসুল (সা.) শাবান মাসে বিশেষভাবে নফল রোজা রাখতে বলেছেন।" (লাতায়িফুল মা’আরিফ, পৃষ্ঠা: ১৮৯)
এ বিষয়ে শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, শুধু ১৫ শাবান রোজা রাখা মাকরুহ। তাই উত্তম হলো, ১৫ শাবানের সঙ্গে আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখা, যেন এটি আইয়ামে বিজের অংশ হিসেবে গণ্য হয়।
সংক্ষেপে
🔹 ১৫ শাবান রোজার ব্যাপারে নির্দিষ্ট সহিহ হাদিস নেই, তবে এটি আইয়ামে বিজের অংশ হওয়ায় রাখা যায়।
🔹 শাবান মাসে বেশি নফল রোজা রাখার প্রতি রাসুল (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন।
🔹 উত্তম হলো, ১৩, ১৪, ১৫ শাবান একসঙ্গে রোজা রাখা, যাতে এটি সুন্নাহ অনুযায়ী হয়।
🔹 কেউ যদি ১৫ শাবান রোজা রাখেন, তবে ইনশাআল্লাহ, তিনি সওয়াব পাবেন।
অতএব, শবে বরাতের রোজার বিষয়ে অতিরঞ্জিত ধারণা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করাই শ্রেয়।
উপসংহার
শবে বরাত একটি বিশেষ রাত, যা অনেক মুসলমান ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পালন করে থাকেন। তবে, এটি উদযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সুন্নাহসম্মত আমল অনুসরণ করতে হবে এবং বিদআত ও ভিত্তিহীন প্রথা পরিহার করতে হবে।
শবে বরাতে ইবাদত করা উত্তম, তবে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ বা দোয়া বাধ্যতামূলক নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এই রাতে তওবা, ইস্তেগফার, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া করা উচিত। একইসাথে, হালুয়া-রুটি বিতরণ, ভাগ্য লিখন বা বিশেষ কোনো আমলকে ফরজ বা সুন্নাহ হিসেবে গণ্য করা ভুল ধারণা।
আসুন, আমরা শবে বরাতের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করি এবং আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাই। বিদআত ও অতিরঞ্জন থেকে দূরে থেকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে সঠিক ইবাদতের মাধ্যমে এই রাতকে অতিবাহিত করি।
শবে বরাত সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এই রাতে কী কী আমল করা উচিত বলে মনে করেন? আপনার মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে শেয়ার করুন! ⬇️💬
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।
সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url